আমাদের সবার চিরচেনা একটি ভেষজ উদ্ভিদ মেথির উপকারিতা নিয়ে অনেকেই অবগত। সবুজ পাতা হলুদ ফুলের মাঝখান থেকে বেরিয়ে আসা এই সোনালী রঙের বীজে বিদ্যমান অনেক প্রয়োজনীয় উপাদান যাতে লুক্কায়িত শারীরিক – মানসিক সুস্থতার গোপন রহস্য। মেথির এইসব উপাদান আবার বিভিন্ন ফেস প্যাক ও হেয়ার প্যাক তৈরীতে কার্যকরী ভূমিকা রেখে একে রূপচর্চার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ উপকরণে পরিণত করেছে।
মেথি একটি ভেষজ উদ্ভিদ যা ‘সয়া’ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এর সতেজ ও শুষ্ক বীজ, পাতা, ডাল এবং মূল ব্যবহৃত হয়ে থাকে মশলা, সুগন্ধিবর্ধক ও ঔষধ হিসেবে। যখন এসব নিয়ে নানা ধরনের তত্ত্ব-গবেষণা তখনই কিছু জরিপে উঠে এলো এর সুস্বাস্থ্য সহায়ক গুণাবলী।
হ্যাঁ আমাদের আজকের আলোচনা ‘মেথি’ নিয়ে। আজ আমরা জানবো মেথির জানা-অজানা নানা উপকারিতা ও অপকারিতার কথা। জানবো, কোন কোন রোগের দাওয়াই এই মেথি। আরো জানবো মেথি দ্বারা হেয়ার প্যাক ও ফেস প্যাক তৈরীর সিক্রেট। চলুন তবে, শুরু করা যাক আজকের ‘মেথি আলাপন’।
একনজরে সম্পূর্ণ আর্টিকেল
খাদ্য হিসেবে মেথির ব্যবহার
খাদ্য হিসেবে মেথির ব্যবহার প্রচুর। আমাদের দৈনন্দিন রান্নাবান্নায় গরম মশলা হিসেবে যেমন মেথির বীজের শুকনো গুঁড়ো মশলা হিসেবে খাওয়া হয় তেমনি মেথি গাাছের পাতাও শাক হিসেবে বহুল জনপ্রিয়। স্বাদটা একটু তেতো হলেও রান্নায় স্বাদ ও সুগন্ধিবর্ধক উপকরণ হিসেবে এর জুড়ি মেলা ভার।
বাঙালির ঘরে ঘরে আর কিছু থাক আর না থাক যে জিনিসটার নিশ্চিত দেখা মিলবে তা হলো আচার। প্রতি সিজনেই কোনো না কোনো ফলের আচার বানানো হয় এদেশের ঘরে ঘরে। আর এই আচার এতো সুস্বাদু হওয়ার পেছনে থাকে ‘পাঁচফোড়ন’ এর অনবদ্য ভূমিকা।
পাঁচফোড়নের যেসব মশলা থাকে তার মধ্যে রাজকীয় আসনে আছে এই মেথি। মোটকথা, এই উপমহাদেশের রন্ধনশালায় নিজগুণে বেশ শক্তপোক্ত জায়গা করে নিয়েছে আমাদের চির পরিচিত এই ‘মেথি’।
শারীরিক সুস্থতায় মেথির কার্যকারীতা
মেথি বীজ অত্যন্ত প্রাচীন কাল থেকেই ভসরতীয় ও চাইনিজদের প্রথাগত ঘরোয়া চিকিৎসার অতি পরিচিত উপাদান। এই বীজ নানাবিধ জটিল শারিরীক সমস্যার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে থাকে। যেমন-
- ক্যান্সার
- ডায়াবেটিস
- স্থুলতা
- উচ্চ-কোলেস্টেরল
- হৃদরোগ
- ব্যকটেরিয়া-ছত্রাক ও ভাইরাস জনিত সংক্রমণ
- উচ্চ রক্তচাপ
- প্রদাহ যন্ত্রণা কমাতে
মেথির পুষ্টি উপাদান
মেথিতে রয়েছে নানাধরনের পুষ্টি উপাদান যা এটিকে একটি শক্তিশালী এন্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। মেথিতে রয়েছে-
- কোলিন
- ইনোসিটল
- বায়োটিন
- vitamin A
- ভিটামিন ডি
- ভিটামিন বি কমপ্লেক্স
- দ্রবণীয় ও অদ্রবণীয় ফাইবার
- লৌহ
মেথির উপকারিতা
এখন পর্যন্ত এমন কোনো তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি যার দ্বারা মেথিকে যেকোনো রোগের দাওয়াই হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া যায়। তা সত্ত্বেও, শত-সহস্র বছর পূর্ব থেকে আজ পর্যন্ত মানুষ নানাবিধ রোগ-ব্যাধির চিকিৎসায় একে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যের সাথেই ব্যবহার করে আসছে।
বর্তমানে স্বাস্থ্যগত ফায়দা হাসিল সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রতিবেদন যাচাই করে মেথির সাহায্যে চিকিৎসা করা যায় এমন রোগের সংখ্যা নেহাত কম নয়।
কিছু কিছু গবেষণা তথ্য জানাচ্ছে যে স্বাস্থ্যের সুরক্ষায় মেথির যে উপকারী দিকগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- হজমে গোলমাল, কোষ্ঠকাঠিন্য, ক্ষুধামন্দা, অম্লতা
- স্তন্যদানকারী মায়ের বুকের দুধের বেশি উৎপাদনে
- ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণে
- পুরুষের দেহে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বৃদ্ধি করতে
- পিরিয়ড চলাকালীন ব্যথা কমাতে
- মেনোপজের চিকিৎসায়
- আর্থাইটিসের চিকিৎসায়
- উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে
- স্থুলতা কমাতে
- শ্বাসকষ্ট কমাতে
- ফোঁড়ার ক্ষত ও ব্যথা সারিয়ে তুলতে
- দীর্ঘক্ষণ কর্মক্ষম রাখতে
- আলসারের চিকিৎসায়
- ক্ষত সারাতে
- মাংসপেশির ব্যথা কমাতে
- মাইগ্রেনের ব্যথা কমাতে
- প্রসব বেদনা কমানোর জন্য।
বহুমুত্র রোগের ঝুঁকি কমাতে মেথি
মেথি বীজ ডায়াবেটিস রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য কারার পাশাপাশি ডায়াবেটিস আক্রান্তদের চিকিৎসায় কার্যকরি ভূমিকা রাখে। মেথি বীজে আছে উচ্চমাত্রায় দ্রবণীয় ফাইবার যা হজম শক্তিকে ধীরজ করার পাশাপাশি দেহের শর্করা শোষণের হারও কমিয়ে আনে।
এই ফাইবার দেহের বিপাকীয় ক্ষমতার উন্নতি করার সাথে সাথে দুই ধরনের ডায়াবেটিস অর্থাৎ ডায়াবেটিস টাইপ-১ ও ডায়াবেটিস টাইপ-২ নিয়ন্ত্রণেও ভূমিকা রাখে।
মেথি বীজ রক্তের অশোষিত গ্লুকোজের ভাঙ্গন প্রতিরোধ করে।এতে আছে বিশেষ ধরনের অ্যামিনো এসিড যার নাম, ৪-হাইড্রক্সিলিউসিন যা একটি এন্টি-ডায়াবেটিক উপাদান হিসেবে পরিচিত।এই উপাদান ইনসুলিন হরমোনের সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি করতে ভূমিকা রাখে।
আর ইনসুলিন হরমোনের কাজই রক্তের গ্লুকোজ ভাঙতে সাহায্য করা। এভাবে, মেথি বীজ খাওয়ার ফলে গ্লুকোজ অবিশ্লেষিত অবস্থায় বেরিয়ে যাওয়া হতে দেহ রক্ষা পায়। ডায়াবেটিস ও নিয়ন্ত্রণে থাকে।
ওবেসিটি বা স্থুলতা কমাতে মেথি
মেথি ক্ষুধা দমন করে অল্পাহারেই পরিপূর্ণ তৃপ্তি এনে দেয় যা তাকে সার্বিকভাবে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
২০১৫ সালে একটি জরিপ চালানো হয়েছিলো ৯ জন স্থুলকায় নারীর উপর যাদের প্রত্যেকেই দুপুরের খাবারের আগে কিছু না কিছু খেতে বলা হয়েছিলো।
তাদের কেউ কেউ মেথির নির্যাস খেয়েছিলেন আবার কেউ কেউ সাধারণ চা জাতীয় পানীয় গ্রহণ করেছিলেন। দুপুরের খাবারের সময় দেখা গিয়েছিলো যেসব নারী মেথির নির্যাস গ্রহণ করেছিলেন অল্পাহারের তাদের তৃপ্তি চলে এসেছিলো অন্য দিকে যারা স্ন্যাকস হিসেবে চা বা অন্যান্য পানীয় খেয়েছিলেন তারা তুলনামূলক পরিমানে বেশিই খেতে পেরেছেন।
এই জরিপ থেকে প্রতিবেদকগণ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, সাধারণ চা অংশগ্রহণকারীদের ক্ষুধা দমন না করলেও মেথির নির্যাস তা করেছে। মেথির গুড়োতে থাকা সলিউবল ফাইবারই মূলত ক্ষুধা দমনে ভূমিকা রাখে এবং অল্পাহারেই পরিপূর্ণ তৃপ্তি এনে দেয়।
স্তন্যদানকারী মায়েদের দুগ্ধের উৎপাদন বাড়াতে মেথি
মেথি বীজ স্তন্যদানকারী মায়েদের বুকের দুধের পরিমাণ ও সরবরাহ বৃদ্ধিতে যথেষ্ট কার্যকারী। ট্রেডিশনাল এশিয়ান মেডিসিনের একজন শিক্ষানবীশ ডাক্তার বুকের দুধের উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য মেথির নির্যাস গ্রহণ করার উপর জোরারোপ করেছেন।
২০১৪ সালের একটি গবেষণায় তথ্য পাওয়া গিয়েছে যে, যেসব মায়েরা সদ্য সন্তান জন্ম দিয়েছেন তারা দুই সপ্তাহ যাবত মেথির চা খেয়ে দারুণ উপকার পেয়েছেন।
টেস্টোস্টেরন হরমোনের বৃদ্ধিতে মেথি
মেথিতে থাকা উপাদান পুরুষের দেহের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হরমোন অর্থাৎ টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি করার সাথে শুক্রাণুর পরিমাণও বৃদ্ধি করে থাকে।
২০১৭ সালে হওয়া একটি জরিপ যাতে ৫০ জন পুরুষ স্বেচ্ছাসেবক অংশ নিয়েছিলেন। তারা ১২ সপ্তাহ যাবত মেথির নির্যাস গ্রহণ করেছিলেন। ফলাফল হলো এই-যে তাদের মধ্যে ৮৫%ই ইতিবাচক সাড়া পেয়েছেন।
এই ফলাফলই নির্দেশ করে যে মেথির নির্যাস ধারাবাহিকভাবে মানসিক স্বাস্থ্য, কামভাব ও মেজাজ নিয়ন্ত্রণের উন্নতি করে।
প্রদাহ কমাতে
মেথি বীজে বিদ্যমান ব্যপক পরিমাণ এন্টিঅক্সিডেন্টের উপস্থিতি একে শক্তিশালী প্রদাহ প্রতিরোধক হিসেবে গড়ে তুলেছে।
হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে
মেথি বীজ রক্তের কোলেস্টেরল লেভেল নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি হৃৎপিণ্ডের সুস্থতা বজায় রাখতেও সাহায্য করে। এর কারণ হিসেবে, বিশেষজ্ঞগণ মতামত ব্যক্ত করেছেন যে, মেথিতে থাকে ৪৮% কঠিন ভোজ্য ফাইবার যা হজম করা বেশ কঠিন।
শুধু তাই নয় এটি ক্ষুদ্রান্ত্রের ভেতরো একটি আঠালো পদার্থের সৃষ্টি করে যা গ্লুকোজ ও চর্বির হজমকে ধীরজ করে দেয় ফলে রক্তসঞ্চালনও নিয়ন্ত্রনে থাকে।
ব্যথা উপশমে
প্রথাগত ঘরোয়া পদ্ধতিতে চলমান টোটকা চিকিৎসায় মেথি বীজ দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
আধুনিক গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষকগণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, মেথিতে থাকা কিছু উপাদান যারা এলকালয়েড হিসেবে পরিচিত তারা সংবেদি রিসেপ্টর সমূহকে বাঁধা দানের মাধ্যমে উজ্জীবিত করে মস্তিষ্ককে ব্যথা অনুভব করাতে সাহায্য করে।
২০১৪ সালের একটি গবেষণায় উঠে আসে, ৫১ জন মহিলা যারা পিরিয়ড চলাকালীন ব্যথায় আক্রান্ত ছিলেন তারা পিরিয়ডের প্রথম ৩ দিন দিনে তিন বার করে মেথি গ্রহণ করেছিলেন।
এইভাবে পর পর দুইমাস ধারাবাহিক ভাবে ব্যবহারের ফলে তাদের পিরিয়ডের ব্যথা অনেকটা উপশম হয়।
রূপচর্চায় মেথির অবদান
বিভিন্ন রোগব্যাধীর পথ্য হিসেবে বহুল ব্যবহারের পাশাপাশি দেহের বাহ্যিক সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করতেও অপ্রতিদ্বন্দী এই মেথি বীজ। এর সাহায্যে প্রস্তুত করা যায় বিভিন্ন হোমমেইড ফেস প্যাক ও হেয়ার প্যাক যা ত্বক ও চুলের নানাবিধ সমস্যার প্রাকৃতিকভাবে সুন্দর সমাধান এনে দেয়। নিচে বিস্তারিত-
ত্বকের যত্নে মেথি
ত্বকের যত্নে মেথির উপকারিতা প্রসিদ্ধ। মেথিতে বিদ্যমান ভিটামিন সি ত্বকের আসল রূপ ধরে রাখার পাশাপাশি দেয় সুন্দর উজ্জ্বলতা। ত্বকের গ্লোয়িংনেস বাড়িয়ে তুলতে ব্যবহার করা যেতে পারে মেথির ফেস প্যাক।
১) ত্বকের উজ্জ্বলতা ধরে রাখতে
ভেজানো মেথিকে পেস্ট করে ফেইস মাস্ক হিসেবে সরাসরি ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি ত্বকে উজ্জ্বলতা আনার পাশাপাশি ডেড সেল গুলোও পরিষ্কার করবে।
১ টেবিল চামচ মেথির শুকনো নির্যাসের সাথে কিছু দুধ মিশিয়ে একটি ফেসিয়াল প্যাক তৈরী করা যা ত্বককে প্রাকৃতিকভাবেই উজ্জ্বলতা এনে দেবে।
২) ত্বক পরিষ্কারক হিসেবে
সারারাত ধরে ভিজিয়ে রেখে দিয়ে সকালে সেই মেথির পেস্ট ব্যবহারে ত্বক পরিষ্কার হয়। ত্বককে গভীর থেকে পরিষ্কার করতে এর জুড়ি নেই। মেথি ভিজানো পানিটাও ব্যবহার করা যায়। এটি ত্বকের অতিরিক্ত তেল ভাব দূর করে ত্বক পরিষ্কার রাখে।
৩) ফেসিয়াল টোনার হিসেবে
সারারাত ধরে ভিজিয়ে রাখা মেথির পানি ফেসিয়াল টোনার হিসেবে দারুণ কাজ করে। এজন্য পানি টাকে প্রথমে একটি স্প্রে বোতলে নিতে হবে। তারপর, ত্বকে ব্যবহার করতে হবে। যেকোনো ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করার আগে এটি ব্যবহার করতে হবে।
৪) খসখসে ত্বকের দাওয়াই হিসেবে
প্রতিদিন ফেসিয়াল করার জন্য পার্লারে যাওয়ার চাইতে এবং কৃত্রিমভাবে তৈরি নানারকম কেমিক্যাল বেইসড মাইক্রোপ্লাস্টিক ব্যবহার করার চাইতে প্রাকৃতিক রিমেডি মেথির পেস্ট ব্যবহার করা শ্রেয়।
এজন্য, প্রথমে নিতে হবে অনেকক্ষণ ধরে ভিজিয়ে রাখা মেথির পেস্ট। তারপর আলতো হাতে মালিশ করতে হবে ত্বকের খসখসে স্থানগুলোতে। এটা শুধুমাত্র রুক্ষ ত্বককে মসৃনই করে না বরং ত্বকের গভীরে লুকিয়ে থাকা ডেড সেল ও অতিরিক্ত তেলও দূর করে।
এটার নিয়মিত ব্যবহার ত্বকের খসখসে ভাব চিরতরে দূর করে।
৫) ত্বকের ময়েশ্চারাইজার হিসেবে
মেথির পেস্ট স্কিন ময়েশ্চারাইজার হিসেবে অনন্য। যাদের ত্বক অতিশয় রুক্ষ, শুষ্ক ও ভাজপড়া তাদের জন্য প্রাকৃতিক প্রতিবিধান লুকিয়ে আছে মেথির ফেসিয়ালের মধ্যে। এটি ত্বকের সমস্ত শুষ্কতা দূর করে ত্বককে যেমন পরিপুষ্ট করে তেমনি এর আদ্রতাও বজায় রাখে।
এই ফেস মাস্ক টি তৈরীর জন্য কিছু পরিমাণ মেথি দানা সারারাত গরম পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। তারপর, এর পেস্ট করে নিতে হবে এবং এর সাথে যোগ করতে হবে ১ টেবিল চামচ মধু ও ২ টেবিল চামচ টকদই। তারপর আলতো হাতে ত্বকে লাগিয়ে রাখতে ১৫ মিনিটের জন্য। এরপর, পানি দিয়ে ত্বক ধুয়ে ফেলতে হবে।
৬) ত্বকের অবাঞ্ছিত দাগ দূর করতে মেথি
ত্বকের কালো দাগের পেছনে আছে ময়লা, ব্যকটেরিয়া, মৃত কোষ ইত্যাদি। আর মেথিতে আছে এদের যম ভিটামিন সি ও ভিটামিন কে। তাই ত্বকের অনাকাঙ্ক্ষিত দাগ দূর করতে মেথির উপকারিতা প্রমাণিত। নিয়মিত এই প্যাকটির ব্যবহার ত্বক সুন্দর রাখে।
সারারাত ধরে ভিজিয়ে রাখা মেথির পেস্ট তৈরী করে তার সাথে কিছু পরিমাণ দুধ মিশিয়ে একটি পেস্ট করে নিতে হবে।তারপর ত্বকে ম্যাসাজ করে অপেক্ষা করতে হবে শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত। তারপর পানি দিয়ে ধুলে ফেলতে হবে।
৭) বয়সের বলীরেখা দূর করতে মেথি
বয়সের ছাপ দূর করে তারুণ্য ধরে রাখতে সহায়ক এই মেথি বীজ। এর উপাদান মূলত ত্বকের ফ্রি রেডিকেলস গুলো দূর করে যা মূলত বয়সের ছাপ পড়তে দেয় না। মেথি ভেজানো পানি ত্বককে আরো বেশি অভেদ্য, সতেজ ও প্রাণবন্ত রাখে।
৮) ব্রণ সমস্যার সমাধানে মেথি
ব্রণ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে আক্রান্তদের উচিত মেথির ফেস মাস্ক ব্যবহার করা কেননা এতে আছে উচ্চমানের এন্টি-ব্যকটেরিয়াল উপাদান। এজন্য একটু বেশি পরিমাণ মেথি নিয়ে পানিতে ফুটাতে হবে প্রায় ১৫ মিনিট যাবত।
তারপর, মেথি ছেঁকে আলাদা করে নিতে হবে। মেথির নির্যাস যুক্ত পানিটাকে এবার ঠান্ডা হতে দিতে হবে। পানিটা ঠান্ডা হওয়ার পর কটন বলের সাহায্যে মুখে অর্থাৎ ব্রণ সংশ্লিষ্ট জায়গায় ব্যবহার করতে হবে।
চুলের যত্নে মেথি
মেথি দানা চুল পড়া কমানোর জন্য একটি অত্যন্ত কার্যকর দাওয়াই। চুলের গোড়া মজবুত করতে মেথির উপকারিতা অনেক যুগ আগে থেকেই প্রসিদ্ধ।
এটি স্ক্যাল্পের বিভিন্ন সমস্যা দূর করার সাথে সাথে খুশকি ও দূর করে। চুল পড়ে যাওয়ার জন্য দায়ী যে দুটি প্রধান কারণ তা হলো স্ক্যাল্পের সমস্যার কারণে চুলের গোড়া হালকা হয়ে যাওয়া এবং খুশকি।
মেথিতে বিদ্যমান উপাদানগুলে এই সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে চুল পড় কমায়। দুইটি উপায়ে এই হেয়ার মাস্ক তৈরী করা যেতে পারে। এগুলো হলো-
- সারারাত ধরে ভিজিয়ে রাখা মেথির পেস্ট তৈরী করে নিয়ে তাতে লেবুর রস মিশাতে হবে। তারপর চুলে ও মাথার তালুতে ভালোভাবে লাগিয়ে নিতে হবে। শুকিয়ে গেলে ধুয়ে ফেলতে হবে।
- নারিকেল তেলের মধ্যে কিছু মেথি দানা ডুবিয়ে রাখতে হবে। তারপর, তেলের বোতলটিকে ঠান্ডা জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে ১০ দিন যাবত। তারপর, তেলটিকে ছেঁকে নিয়ে চুলে ম্যাসাজ করতে হবে। এই দুটো হেয়ার টনিক নিয়মিত ব্যবহারে চুল পড়া বন্ধ হবে।
খুঁশকি দূর করতে মেথি
মাথার ত্বকে বাসা বাঁধতে পারে এমন ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া মূলত ড্যানড্রাফ সৃষ্টির জন্য দায়ী। সৌভাগ্যক্রমে, মেথি দানায় বিদ্যমান এন্টি-ব্যকটেরিয়াল ও এন্টি-ফাংগাল উপাদান গুলো খুশকির যম। এই হেয়ার প্যাক তৈরীর জন্য চিরাচরিত নিয়মে মেথির পেস্ট তৈরী করে নিতে হবে।
এরপর, এর সাথে যোগ করতে হবে টক দই। তারপর মিশ্রণটি ভালেভাবে চুলে ও স্ক্যাল্পে ম্যাসাজ করতে হবে। ১ ঘন্টা রেখে দেয়ার পর ধুয়ে ফেলতে হবে। এভাবে সপ্তাহে দুইবার ব্যবহার করার মাধ্যমে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে।
চুলের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে
প্রাকৃতিকভাবে সিল্কি, সুন্দর চুল পেতে কেনা চায়। চুলের যত্নে মেথি দিতে পারে এমনই চমকপ্রদ ফলাফল। এজন্য যা করতে হবে-
- ১/২ কাপ মেথির পেস্টের সাথে যোগ করতে হবে টকদই ও লেবুর রস। তারপর এই প্যাক টি চুলে ভালো মতো লাগাতে হবে। ৪৫ মিনিট রেখে দিয়ে তারপর হালকা শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।
- সারারাত মেথি ভিজিয়ে রেখে সকালে নির্যাস মিশ্রিত পানিটা সরাসরি চুলে লাগাতে হবে।
তাহলে আর কেনো বাজারের কৃত্রিম পণ্য ব্যবহার করা! চুলের যত্ন হোক প্রাকৃতিক উপাদান – মেথিতে।
চুল লম্বা ও বৃদ্ধি করে
চুল মেয়েদের অলঙ্কার-অহংকার। সুন্দর লম্বা প্রাণবন্ত চুল কে না চায়! চুলের বৃদ্ধিতেও রয়েছে মেথির অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা। চুলের বৃদ্ধির জন্য যে হেয়ার প্যাক টি লাগবে তা হলো-
১/২ কাপ মেথির পেস্টের সাথে ১ টেবিল চামচ আলোভেরা জেল, তার সাথে ১ টেবিলচামচ নারিকেল তেল ও কয়েক ফোটা রোজমেরি ওয়েল।
সব উপাদান ভালো ভাবে মিশিয়ে মাথার তালু ও চুলে মাখিয়ে রাখতে হবে আধাঘন্টা যাবত।তারপর ধুয়ে ফেলতে হবে। এই মাস্কটি নিয়মিত ব্যবহারে উপকার মিলবে।
চুল অকালে পেকে যাওয়া রোধে মেথি
মেথির অন্যতম একটি উপাদাব পটাসিয়াম যা চুলের অকালে পেকে যাওয়া প্রতিরোধ করে। এজন্য -মেথির পেস্টের সাথে আমলার নির্যাস যোগ করে চুলে লাগাতে হবে। এক ঘন্টা অবধী রেখে তারপর তুলে ফেলতে হবে।
এভাবে মেথি ত্বক ও চুলের যত্নে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।
মেথির অপকারিতা
এতো এতো মেথির উপকারিতা বিদ্যমান থাকলেও অপরিমিত ব্যবহারে সৃষ্টি হতে পারে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক অস্বস্তি। যেমন-
- ডায়রিয়া
- হজমে গোলমাল
- দুর্গন্ধযুক্ত মুত্র, ঘাম ও স্তন
- মাথা ঘোরা
- মাথা ব্যথা
- গা ফোলা
- গর্ভাবস্থায় অসময়ে জরায়ুজ সংকোচন
- গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল জটিলতা
- হরমোনাল ক্যান্সার খারাপ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া
- এলার্জি বাড়িয়ে দেয়া, ইত্যাদি।
তাই, কোনো ধরনের শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির মেথি গ্রহণের বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। হয় ধারাবাহিক ভাবে মেথি ব্যবহার করতে হবে আর নয় তো একেবারেই পরিহার করতে হবে।
মেথিতে থাকা কিছু উপাদান নারীদেহের গুরুত্বপূর্ণ হরমোন এস্ট্রোজেনের মতো কাজ করে যা গ্রহণের ফলে দেহের হরমোনের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে এবাং খারাপ ফলাফলের কারণ হতে পারে।
এর অপকারী দিক সমূহ আরো ভালোভাবে জানার জন্য আরো বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন হবে আলে জানিয়েছেন গবেষকগণ। তাই, খাদ্যতালিকায় মেথির সংযুক্তির আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
শেষ কথা
আমরা চেষ্টা করেছি মেথির উপকারিতা ও অপকারিতা তুলে ধরতে, শরীর ও রূপচর্চায় মেথির বিভিন্ন কার্যকারিতা এবং ফেসপ্যাক বানানোর কৌশলও জেনেছি।
রক্তে অবিশ্লেষিত গ্লুকোজের আনাগোনা ও কম পরিমাণ টেস্টোস্টেরনের উৎপাদনের চিকিৎসায় লোকজন সহস্র বছর ধরেই মেথির দাওয়াই নিয়ে আসছে।
যদিও মেথির অনেক স্বাস্থ্যগত উপকারিতা আছে তথাপি মেথি কখনোই কোনো অসুস্থতাকে পরিপূর্ণ আরোগ্য দিতে পারে না। তাই, অন্ধের মতো পুরোপুরি ঘরোয়া টোটকায় নির্ভর না করে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়াই শ্রেয়।