ডিমেনসিয়া কি : ডিমেনসিয়া মস্তিষ্কের এমন একটি condition যার কারণে ধীরে ধীরে আক্রান্ত রোগী সবকিছু ভুলে যায় এবং একেবারেই অচল হয়ে পড়ে। ডিমেনসিয়াকে স্মৃতিভ্রংশ ও বলা হয়।
ভুলে গেছি বা মনে নেই, এই শব্দগুলোতো আমরা প্রতিদিনই কোনো না কোনো সময়ে বলি। এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবেনা যে কিনা কখনো এই কথাগুলো বলেনি।
প্রায় সময়ই আমরা এক রুম থেকে অন্য রুমে গিয়ে ভুলে যাই কেনো এসেছি, চোখের চশমা খুলে কোথায় রেখেছি মনে থাকেনা কিংবা হয়তো অনেকের নামও কিছু সময়ের জন্য ভুলে যাই।
এইসব তো একেবারেই স্বাভাবিক। তবে আজকে ডিমেনসিয়া রোগ সম্পর্কে আলোচনা করবো, যেখানে এই স্বাভাবিক ভুলে যাওয়াগুলো আর স্বাভাবিক থাকেনা। রূপ নেয় প্রচণ্ড কষ্টদায়ক আর ভয়াবহ অবস্থার। রোগটির নাম ডিমেনসিয়া (dementia)।
একনজরে সম্পূর্ণ আর্টিকেল
ডিমেনসিয়া কি | What is Dementia?
ডিমেনসিয়াকে আসলে কোনো রোগ বলা ঠিক নয় বরং, এটি একটি কনডিশান (condition)। যে সকল রোগের কারণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে আক্রান্ত ব্যাক্তির স্মৃতি, চিন্তাশক্তি, কথা বলা, প্রতিদিনকার কাজ করার ক্ষমতা লোপ পায়, সেগুলোকেই ডিমেনসিয়া বলা হয়।
এটা খুবই আফসোসের বিষয় যে বেশিরভাগ মানুষই এখনও ডিমেনসিয়া শব্দটির সাথে একেবারেই পরিচিত না। অথচ সারা বিশ্বে ৫০ মিলিয়নেরও বেশি ডিমেনসিয়া আক্রান্ত, প্রতি বছর ১০ মিলিয়ন নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে।
ডিমেনসিয়া সম্পর্কে আরো সামনে যাওয়ার আগে ছোটো করে আমাদের মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে, তা বলে নেই কারণ ডিমেনসিয়া মূলত মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজগুলোকেই নষ্ট করে দেয়।
আমাদের মস্তিষ্ক কাজ করে মূলত electrical ও chemical কিছু সিগন্যালের মাধ্যমে। এক নিউরন(nerve cell) থেকে অন্য নিউরনে এই সিগন্যাল আদান প্রদান হয়। এই সিগন্যাল গুলোই বিভিন্নভাবে কাজ করে আমাদের কোনো কিছু মনে রাখতে, চলাফেরা বা যেকোনো কাজ করতে এমনকি কথা বলতে।
অর্থাৎ, সমস্ত কাজ চলে এই সিগন্যাল গুলোর মাধ্যমেই। মনে রাখার বিষয়, সিগন্যাল আদান প্রদান হয় নিউরনের মাধ্যমে। কেনো মনে রাখতে হবে, তা একটু পরেই পরিস্কার হয়ে যাবে।
ডিমেনসিয়ার প্রকারভেদ বা ভুলে যাওয়ার কারণ
প্রথমেই বলেছিলাম ডিমেনসিয়া নিজে কোনো রোগ নয়। বিভিন্ন রোগের কারণে ডিমেনসিয়া হয়। তাই ডিমেনসিয়া কারণ গুলোই প্রকারভেদ।
ডিমেনসিয়ার প্রধান কারণ অ্যালজেইমারস ডিজিজ (alzheimer’s disease)। অ্যালজেইমারস ডিজিজ হয় মস্তিষ্ক কোষে অ্যাবনরমাল প্রোটিন বিল্ড-আপ (abnormal protein buildup) এর কারণে। অর্থাৎ, মস্তিষ্কের কোষের চারপাশে অদ্রবণীয় (insoluble) প্রোটিন জমা হওয়ার কারণে। যার ফলে আক্রান্ত ব্যাক্তির নিউরন সিগন্যাল আদান প্রদান ব্যাহত হয় এবং রোগীর স্মৃতি, চিন্তা ও কাজ করার ক্ষমতা ধ্বংস হয়ে যায়।
আরেকটি কারণ হলো, ভাস্কুলার ডিমেনসিয়া (vascular dementia). ভাস্কুলার ডিমেনসিয়ার কারণ রক্ত চলাচলের vessel বা রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া। ফলে মস্তিষ্কের কোষে রক্ত অর্থ্যাৎ অক্সিজেন পৌঁছাতে পারেনা এবং নিউরনগুলো অক্সিজেনের অভাবে মারা যায়। ভাস্কুলার ডিমেনসিয়ার কারণে রোগী সমস্যা সমাধান করতে পারেনা, কাজে মনোযোগ ব্যাহত হয় এমনকি রোগীর সাধারণ চিন্তা ভাবনাও কঠিন হয়ে পড়ে।
লিউই বডি ডিমেনসিয়া (Lewy body dementia) আরো একটি প্রধান কারণ। এক্ষেত্রেও মস্তিষ্কে বেলুনের মতো করে মস্তিষ্ক কোষের চারপাশে প্রোটিন জমা হয়। এই রোগের কারণে হ্যালিউসিনেশন (hallucination), চলাফেরার গতি কমে যায়, হাত পা কাঁপা সহ আরো অনেক ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়।
ফ্রন্ট-টেম্পোরাল ডিমেনসিয়া( Front temporal dementia): ফ্রন্টোটেম্পোরাল ডিমেনসিয়া সরাসরি nerve cell কে নষ্ট করে দেয় বা ভেঙে দেয়। যার কারণে ভাষাগত সমস্যা শুরু হয় এবং রোগী এক পর্যায়ে কথা বলার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে, একজন রোগীরই অনেকগুলো কারণ একসাথে থাকতে পারে। এই অবস্থা কে বলা হয় mixed dementia বা মিশ্র ডিমেনসিয়া।
আরো কিছু রোগও ডিমেনসিয়া তৈরি করতে পারে। যেমন: huntington’s disease, traumatic brain injury, parkinson’s disease ইত্যাদি।
ডিমেনসিয়া কাদের হয়?
বয়সের দিক থেকে সাধারণত ৬০ বছরের উর্ধ্বে এমন বয়সের মানুষই ডিমেনসিয়া রোগে আক্রান্ত হয়। এখন, বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে যে বয়সের সাথে স্বাভাবিকভাবেই স্মৃতি কিছুটা কমে আসে, তবে ডিমেনসিয়া রোগীর পার্থক্য কোথায়?
সাধারণভাবে অনেক সময়েই অনেক কিছু ভুলে গেলেও কিছু সময় পরই তা মনে পড়ে যায় এবং স্বাভাবিক কাজকর্মও চলতে থাকে।
তবে, ডিমেনসিয়া রোগী সহজে মনে করতে পারেনা, এমনকি ৩/৪ মিনিট পূর্বের ঘটনাও ভুলে যান। আবার তা মনে করতে পারলেও স্বাভাবিক কাজ চালিয়ে নিতে পারেন না, কাজকর্মেও অস্বাভাবিকতা খেয়াল করা যায়।
তবে যেকোনো বয়সেই ডিমেনসিয়া হতে পারে। এছাড়াও, ভিটামিন স্বল্পতা, মদ্যপান, কিছু ক্ষেত্রে পরিবারের কারো এই রোগ থাকলেও ডিমেনসিয়া হতে পারে। তবে হৃদরোগী, ডায়াবেটিস রোগীদের ডিমেনসিয়া হওয়ার সম্ভবনা বেশি।
ডিমেনসিয়া রোগের লক্ষণ বা symptoms
- অস্বাভাবিক স্মৃতিলোপ
- কথা বলার সময় শব্দ খুঁজে না পাওয়া
- একই প্রশ্ন বারবার করা
- নিজের বাসার ঠিকানা ভুলে যাওয়া বা পরিচিত কারো নাম, চেহারা ভুলে যাওয়া
- সাধারণ সমস্যা সমাধান করতে না পারা
- কোনো কাজ সঠিকভাবে গুছিয়ে করতে না পারা
- চিন্তা করার ক্ষমতা লোপ পাওয়া
- বিভ্রান্তি তৈরি হওয়া
- Hallucination হওয়া
- কথা বলতে সমস্যা অনুভব করা ইত্যাদি।
এই লক্ষণগুলো সাধারণত খুব কাছের কেউ যেমন স্ত্রী, ছেলে মেয়ে বা মা বাবা, এরাই প্রথম ধরতে পারেন। যখনই এই লক্ষণগুলোর কোনো একটি বা একাধিক লক্ষ্য করবেন নিজের ভিতর বা পাশের ভালোবাসার মানুষটির ভিতর, দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া খুব জরুরী।
কারণ, বেশিরভাগ সময়েই ডিমেনসিয়ার এই লক্ষণগুলোকে বয়সের কারণে স্বাভাবিক মনে করে অনেকেই গুরুত্ব দেন না। পরে রোগের একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে বুঝতে পারলেও তখন আর কিছু করার থাকেনা।
ডিমেনসিয়ার ধাপ | Stages of Dementia
ডিমেনসিয়া রোগীর অবস্থা ধীরে ধীরে প্রচণ্ড খারাপ হতে থাকে। অনেক সময় লক্ষণ প্রকাশ পায় অনেক দেরিতে। এই ধীরে ধীরে হওয়া পরিবর্তনগুলোকে কয়েকটি ধাপে আলাদা করা যায়।
প্রথম ধাপ: প্রথম অবস্থায় লক্ষণগুলোকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়না। কোনো কারণে টেস্ট (test) করা হলে ধরা পড়ার সম্ভবনা রয়েছে। এই ধাপকে no impairment ধাপ ও বলা হয়।
দ্বিতীয় ধাপ: হলো very mild decline stage. এই অবস্থায় রোগীর সামান্য কিছু লক্ষণ প্রকাশ পেলেও সে কিন্তু তার প্রতিটি কাজ নিজেই করতে পারে।
তৃতীয় ধাপ: এরপরের ধাপ কে বলা হয় mild decline stage. এই অবস্থায় আপনার কাছের মানুষটির ভিতর আরো অনেক পরিবর্তন দেখতে পাবেন। হয়তো সে ভুলে যাচ্ছে বারবার কিংবা নিজের ছোটবেলার বা জীবনের কোনো ঘটনার গল্প তৈরি করবে। কারণ তার মস্তিষ্কের কিছু স্মৃতি হারিয়ে যেতে শুরু করে, তা সে পূরণ করার চেষ্টা করে। পাশের কারো সাহায্যে হয়তো আবার তা মনেও করতে পারে, তবে তা মনে রাখাটা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।
চতুর্থ ধাপ: এরপর শুরু হয় moderate decline stage. এই ধাপে এসে রোগীর অবস্থা আরও একটু খারাপের দিকে চলে যায়। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাও ভুলে যেতে শুরু করে, বেড়াতে যাওয়া বা টাকা পয়সার হিসাব রাখা তার জন্য কঠিন হয়ে যায়। Moderately severe decline অবস্থায় এসে রোগী তার নিজের ফোন নম্বর, পরিচিত কারো নাম ভুলে যেতে শুরু করে। সপ্তাহের দিনগুলো মনে করতে পারেন না। এমনকি প্রতিদিনকার কাজ করতেও খুব সমস্যায় পড়ে যায়।
পঞ্চম ধাপ: এর পরের অবস্থা হলো severe decline stage. রোগীর অবস্থা এই পর্যায়ে এসে আরো খারাপ হয়ে যায়। সে তার খুব কাছের মানুষের নাম মনে করতে পারেনা, হয়তো তার স্ত্রী বা ছেলে মেয়ে! কথা বলতেও সমস্যা শুরু হয় ।নিজে নিজে খেতে পারেনা বা কাপড়ও পড়তে কষ্ট বোধ করে।
ষষ্ঠ ধাপ: ডিমেনসিয়ার সবশেষ অবস্থা হলো very severe decline stage. এই অবস্থায় এসে আসলে রোগীর আর কোনো অস্তিত্ব থাকেনা। পাশের মানুষটিকে দেখবেন আপনার চোখের সামনে নিঃশেষ হয়ে যেতে। এই অবস্থায় এসে রোগী কাউকেই আর চিনতে পারেনা, চলাফেরা করতে পারেনা, খেতে পারেনা, পুরোপুরি নিশ্চল হয়ে পড়ে।
ডিমেনসিয়া রোগী নিজে যেমন কষ্ট পায়, তার পাশের মানুষগুলো তার চেয়েও বেশি কষ্টে থাকে। একসময় বিরক্ত চলে আসে। প্রতিদিনকার একটু একটু করে পাশের মানুষটার হারিয়ে যাওয়া মেনে নেয়াটা বড্ড কষ্ট দেয়। একসময় বোঝা মনে হয়, মনে হয় কেনো সে চলে যায়না। প্রচণ্ড অসহায় হয়ে মৃত্যু হয় মানুষটার।
ডিমেনসিয়া রোগের চিকিৎসা
ডিমেনসিয়া রোগের সত্যিকার অর্থে চিকিৎসা নেই। একেবারে শুরুর দিকে ধরতে পারলে হয়তো কিছুটা আশা থাকে সুস্থ্য হওয়ার। তবে বেশিরভাগ সময়েই রোগটি ধরা পড়ে একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে। তখন আর কিছু করার থাকেনা।ডিমেনসিয়া এমন একটি condition যা থেকে ফিরে আসার বা একেবারে সুস্থ হওয়ার কোনো রাস্তা নেই, একবার হলে আজীবন বহন করতে হয়।
তবে কিছু ঔষধ দিয়ে কিছুদিন দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। তাই প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ করতে চেষ্টা করাটা বেশি দরকার। অবশ্য এর প্রতিরোধ ও সম্ভব নয়, আমরা যা করতে পারি তা হলো ঝুঁকি গুলো এড়িয়ে চলা।
গবেষণায় দেখা যায়, যারা নিয়মিত ব্যায়াম করেন, ধূমপান, মদ্যপান থেকে দূরে থাকেন, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খান বা healthy diet মেনে চলেন তাদের ঝুকি কম থাকে। পাশাপাশি মন এবং মস্তিষ্ককে সবসময় কাজের ভিতর রাখা উচিত। যে কাজ করতে ভালো লাগে, তাই করুন। বই পড়া, জটিল সমস্যা সমাধান করা, puzzle solve বা word matching এক্ষেত্রে খুবই উপকারী ভূমিকা পালন করে। প্রতিদিন যথেষ্ট পরিমাণ ভিটামিন খাওয়া, এবং যেকোনো রোগের যতো দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা করানোটা খুবই জরুরী।
আসা করা যায়, এই নিয়মগুলো মেনে চললে আমরা নিজেদের ও পাশের মানুষটির ডিমেনসিয়ার ঝুঁকি কমিয়ে আনতে পারবো।
ডিমেনসিয়া নিয়ে শেষ কথা
ডিমেনসিয়া বর্তমানে একটি মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি করেছে বর্তমানে। বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন কি করে এর প্রতিকার করা যায়। তবে, আমাদের সচেতনতা ও রোগীর প্রতি যত্নশীলতা ঝুঁকি কমাতে এবং রোগীকে আরো কিছুদিন স্বাভাবিক জীবন যাপনে সাহায্য করতে পারে।