চিয়া সিড ( chia seed ) আমাদের অনেকের কাছে পরিচিত হলেও চিয়া সিড কি, চিয়া সিড এর উপকারিতা ও চিয়া সিড খাওয়ার নিয়ম অধিকাংশই জানিনা। না জানার কারণে চিয়া সিডের অসাধারণ সব উপকারিতা থেকে প্রতিনিয়ত আমরা নিজেদেরকে বঞ্চিত করছি।
সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ স্বরূপ। বর্তমান সময়ে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকল বয়সের সকল পেশার মানুষই পূর্বের তুলনায় নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে বেশি সচেতন। আর সেই সচেতনতার রোজনামচায় একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে বেশ কিছু খাদ্য উপাদান, যেগুলোর মধ্যে চিয়া সিড অন্যতম।
চিয়া সিড বর্তমান সময়ে আলোচিত একটি নাম হলেও অনেকেই হয়ত এর পুষ্টি গুণাগুণ সম্পর্কে অজ্ঞ। আর তাদের জন্যেই আজকের এই আর্টিকেলটি। আমরা আর্টিকেলটি পড়া শেষে চিয়া সিড কি ( What is chia seed in Bangla )? চিয়া সিড খাওয়ার উপকারিতা, অপকারিতা, চিয়া সিড খাওয়ার নিয়ম এবং চিয়া সিডের তৈরি খাবার রেসিপি সম্পর্কে জানবো ইন-শা-আল্লাহ।
একনজরে সম্পূর্ণ আর্টিকেল
চিয়া সিড কি | What is chia seeds
চিয়া উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত ক্ষুদ্র কালো বীজটিই চিয়া সিড বলে পরিচিত, যার বৈজ্ঞানিক নাম Salvia hispanica। সাদা, কালো এবং বাদামি বর্ণের এই মসৃণ বীজগুলো আকারে ক্ষুদ্র এবং ডিম্বাকৃতির হয়ে থাকে। চিয়া সিডের অপর নাম সালবা চিয়া (Salba chia) বা মেক্সিকান চিয়া (Mexican chia)।
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেও চিয়া সিড বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রাচীনকালে তা অ্যাজটেক সভ্যতা এবং মায়ান সভ্যতার মতো বেশ কিছু মেসোআমেরিকান (Mesoamerican) সংস্কৃতির প্রধান শস্য ছিলো। ইতিহাসবিদদের মতে, “চিয়া” একটি প্রাচীন মায়ান শব্দ, যার অর্থ “শক্তি”।
অ্যাজটেক এবং মায়ানদের খাদ্যাভ্যাস এবং দৈনন্দিন রূপচর্চার পাশাপাশি ঔষধি চাহিদা পূরণেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতো এই চিয়া সিড। উল্লেখ্য, এই দুটি সভ্যতা বর্তমান মেক্সিকো এবং গুয়েতমালার বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করতো।
বর্তমানে মেক্সিকো, গুয়েতমালা, পেরু, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ অনেক দেশে চিয়া সিড চাষের পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে বিস্তৃতি লাভ করছে।
চিয়া সিড খাওয়ার নিয়ম | how to eat chia seeds
চিয়া সিড খাওয়ার নিয়ম অনেক রয়েছে। বিভিন্ন পদ্ধতিতেই চিয়া সিড খাওয়া যায়, যেমন:
- স্মুথি বানিয়ে
- সালাদ হিসেবে
- ড্রিংকস তৈরি করে
চিয়া সিডকে আলাদা করে রান্না করা লাগে না, বরং এটি কিছু নির্দিষ্ট খাবারের (ওটস, পুডিং, জুস, স্মুদি ইত্যাদি) সাথে মিশিয়ে খেয়ে নেয়া যায়। এছাড়াও কেউ চাইলে টকদই, সিরিয়াল, রান্না করা সবজি বা সালাদের ওপরে ছড়িয়েও খেতে পারেন।
স্বাস্থ্য সচেতনদের জন্য চিয়া সিডের পুডিংয়ের রেসিপি দেয়া হলোঃ
উপকরণ
- চিয়া সিড – ১ আউন্স (২৮ গ্রাম বা ২ টেবিল চামচ)
- তরল দুধ – হাফ কাপ (১১৮ মিলি)
- ম্যাপল সিরাপ/মধু (অপশনাল) – ১ টেবিল চামচ
প্রস্তুত প্রণালী
- একটি বোলে চিয়া সিড ও তরল দুধ ভালোকরে মিশিয়ে নিতে হবে। সবশেষে বাড়তি ফ্লেভারের জন্য মধু বা ম্যাপল সিরাপ যোগ করা যেতে পারে।
- এবার মিশ্রণটিকে একটি জারে নিয়ে সারা রাত রেফ্রিজারেটরে রেখে দিতে হবে। সময়স্বল্পতা থাকলে কয়েক ঘন্টা রেখে দিলেও চলবে।
- খাওয়ার আগে পছন্দমতো যেকোনো তাজা ফলের টুকরো বা বাদাম কুচি ছড়িয়ে নেয়া যেতে পারে।
- যারা চিয়া পুডিংয়ে স্বাদের ভিন্নতা আনতে চান, তারা চাইলে নারকেল কুচি, পিনাট বাটার বা কোকো পাউডারও ব্যবহার করতে পারেন।
চিয়া সিডের পুষ্টিগুণ
ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অফ এগ্রিকালচার (United States Department of Agriculture) বা ইউএসডিএ (USDA) এর ন্যাশনাল নিউট্রিয়েন্ট ডাটাবেজ হতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ৩.৫ আউন্স (১০০ গ্রাম) চিয়া সিডে রয়েছেঃ
- ৪৮৬ ক্যালোরি
- ৬% পানি
- ৪২.১ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট
- ৩৪.৪ গ্রাম ফাইবার বা খাদ্যআঁশ
- ১৬.৫ গ্রাম প্রোটিন
- ০ গ্রাম চিনি
- ০% গ্লুটেন
- ৩০.৭ গ্রাম ফ্যাট
উল্লেখ্য, চিয়া সিডে এই ৩০.৭ গ্রাম ফ্যাটের মাঝে
- স্যাচুরেটেড: ৩.৩৩ গ্রাম
- মনোস্যাচুরেটেড: ২.৩১ গ্রাম
- পলিঅনস্যাচুরেটেড: ২৩.৬৭ গ্রাম
- ওমেগা -3: ১৭.৮৩ গ্রাম
- ওমেগা -6: ৫.৮৪ গ্রাম
- ট্রান্স: ০.১৪ গ্রাম
এছাড়াও চিয়া সিড আমাদের দেহে ক্যালসিয়াম, জিংক, আয়রন, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খনিজ উপাদানের দৈনন্দিন পুষ্টিচাহিদাকে পূরণ করতে সক্ষম হলেও এতে ফলেট, ভিটামিন এ এবং কপারের আধিক্য প্রায় নেই বললেই চলে। তবে এতে ভিটামিন বি-১ এর উৎস হিসেবে থায়ামিন (thiamine) রয়েছে দৈনন্দিন খাদ্য চাহিদার প্রায় ১৫ শতাংশ, এবং ভিটামিন বি-৩ এর উৎস হিসেবে নায়াসিন (niacin) রয়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ।
১। শর্করা এবং খাদ্যআঁশ
চিয়া সিডে বিদ্যমান শর্করার ৮০ ভাগেরও বেশি খাদ্যআঁশ হিসেবে থাকে। প্রতি ১ আউন্স অর্থাৎ ২৮ গ্রাম চিয়া সিডে প্রায় ১১ গ্রাম খাদ্যআঁশ থাকে, রেফারেন্স ডেইলি ইনটেক (Reference Daily Intake) বা আরডিআই (RDI) অনুযায়ী যা একজন পুরুষ/নারীর দৈনন্দিন খাদ্যআঁশ চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট।
উল্লেখ্য, একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ এবং নারীর দৈনিক যথাক্রমে ৩৮ ও ২৫ গ্রাম করে ফাইবার বা খাদ্যআঁশ প্রয়োজন।
চিয়া সিডের ফাইবার মূলত দ্রবণীয়, এবং এতে থাকা মিউসিলেজ (mucilage) নামক রাসায়নিক পদার্থের কারণে বীজটি ভেজানোর পর তা চটচটে আঠালো রূপ ধারণ করে।
চিয়া সিডের খাদ্যআঁশ আমাদের অন্ত্রে গাঁজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শর্ট চেইন ফ্যাটি এসিড (short-chain fatty acid) গঠন করে এবং কোলনের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে।
২। ফ্যাট
হৃদযন্ত্রের জন্য উপকারী ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের আধিক্য চিয়া সিডকে পুষ্টি গুণাগুণে অনন্য করে তুলেছে। চিয়া সিডের প্রায় ৭৫% ফ্যাট ওমেগা-3 আলফা-লিনোলিক অ্যাসিড (alpha-linolenic acid) বা ALA নিয়ে গঠিত, যেখানে প্রায় ২০% ওমেগা-6 ফ্যাটি অ্যাসিডও রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চিয়া সিডে ফ্ল্যাক্সসিড বা তিসির বীজের তুলনায়ও বেশি মাত্রায় ওমেগা -3 ফ্যাটি অ্যাসিডের উপস্থিতি রয়েছে। তারা এও বিশ্বাস করেন যে, ওমেগা -6 এর তুলনায় ওমেগা -3 এর উচ্চমাত্রায় গ্রহণ দেহের প্রদাহ কমাতে সহায়ক।
উল্লেখ্য, আমাদের দেহে চিয়া সিডের আসল কার্যকারিতা নির্ভর করে এতে বিদ্যমান ALA কতটা সক্রিয়ভাবে EPA এবং DHA তে রূপান্তরিত হতে পারে।
৩। প্রোটিন
চিয়া সিডে রয়েছে দৈনন্দিন চাহিদামাত্রার প্রায় ১৯ শতাংশ প্রোটিন, যা হয়ত যেকোন গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যবীজের সমান কিন্তু যেকোন খাদ্যশস্যের চেয়ে বেশি। এতে রয়েছে নয়টি গুরুত্বপূর্ণ অ্যামিনো এসিডের সমাহার, যেগুলোর মাঝে একটি উচ্চমানের উদ্ভিজ্জ প্রোটিন হিসেবে বিবেচিত। তবে শিশুদের জন্য একমাত্র প্রোটিনের উৎস হিসেবে এটি না ব্যবহার না করাই ভালো।
৪। খনিজ পদার্থ
চিয়া সিড ভিটামিনের একটি দুর্বল উৎস হলেও এটি খনিজ পদার্থে বেশ সমৃদ্ধ। এতে রয়েছেঃ
- ম্যাঙ্গানিজ: খাদ্য পরিপাক, দৈহিক বৃদ্ধি এবং বিকাশে সহায়ক।
- ফসফরাস: হাড়ের স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং টিস্যু গঠন করে।
- কপার: হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
- সেলেনিয়াম (Selenium): একটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে বিভিন্ন শারীরিক প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
- আয়রন: দেহে অক্সিজেন সরবরাহে ভূমিকা রাখে।
- ম্যাগনেসিয়াম: বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দৈহিক প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখে।
- ক্যালসিয়াম: হাড়, মাংসপেশী এবং স্নায়ুর সুরক্ষায় কার্যকর।
জেনে নেয়া ভালো, চিয়া সিডে বিদ্যমান ফাইটিক এসিডের (phytic acid) উপস্থিতি এতে থাকা আয়রন এবং জিংকের দুর্বল শোষণের জন্য দায়ী।
চিয়া সিড খাওয়ার উপকারিতা
১। পুষ্টি গুণাগুণে অনন্য
প্রাচীন সভ্যতার মানুষেরা চিয়া সিডকে পুষ্টিমানে সমৃদ্ধ একটি খাদ্যবীজ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলো, যা বর্তমান বিশ্ব এবং আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান কর্তৃক সমর্থিতও বটে।
পুষ্টিবিদদের মতে, প্রতি আউন্স (২ টেবিল চামচ) চিয়া সিডে রয়েছে ৫ গ্রাম ALA, দৈনন্দিন চাহিদার ১৪% ক্যালসিয়াম, ১২% আয়রন, ২৩% ম্যাগনেসিয়াম, ২০% ফসফরাস, ১২% জিংকসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট। এজন্য পুষ্টিবিদরা প্রতিদিন অন্তত ১ আউন্স করে চিয়া সিড সেবনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
২। অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের সমৃদ্ধ উৎস
চিয়া সিডে বিদ্যমান উদ্ভিজ্জ যৌগগুলো আমাদের দেহে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে এবং দেহকে সুস্থ স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। যেমনঃ
- ক্লোরোজেনিক এসিড (Chlorogenic acid): রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে।
- ক্যাফেইক এসিড (Caffeic acid): বিভিন্ন উদ্ভিজ্জ খাদ্যদ্রব্যে থাকা এই গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্টটি আমাদের দেহের বিভিন্ন প্রদাহের বিরুদ্ধে লড়াই করে।
- কোয়ারসেটিন (Quercetin): এই শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্টটি হৃদরোগ, অস্টিওপোরোসিস এবং বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
- কেম্পফেরল (Kaempferol): ক্যান্সারসহ অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদী রোগের ঝুঁকি কমাতে কার্যকর।
- মাইরিসেটিন (myricetin): ক্যান্সারের জন্য দায়ী কোষগুলোকে ধ্বংস করার পাশাপাশি অস্টিওপোরোসিস এবং অ্যালার্জির বিরুদ্ধে কার্যকর।
চিয়া সিডে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলো যে এতে বিদ্যমান গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাটগুলোকে রক্ষাই করে তা না, বরং আমাদের দেহে থাকা ফ্রি র্যাডিক্যাল নামক বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল যৌগের বিরুদ্ধে কাজ করে দেহকে সুস্থ রাখে। উল্লেখ্য, এই ফ্রি র্যাডিকেলগুলো আমাদের মানসিক বিকাশ রোধের পাশাপাশি দেহের সুস্থ কোষগুলোকে ধ্বংস করে দেয়।
এছাড়াও চিয়া সিডের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আমাদের হৃদযন্ত্র এবং যকৃতের সুস্থ কার্যক্রমে সাহায্য করে।
৩। ওজন কমাতে কার্যকর
চিয়া সিডে উচ্চমাত্রার ফাইবার এবং প্রোটিন থাকায় যারা ওজন কমাতে চান, তাদের জন্য এটি বেশ উপকারী। প্রতি ২৮ গ্রাম চিয়া সিডে ১০ গ্রাম ডায়েটারি ফাইবার থাকে, যা আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যচাহিদার প্রায় ৩৫%।
চিয়া সিডে বিদ্যমান ফাইবার বা খাদ্যআঁশ মূলত দ্রবণীয়। এটি পানি শোষণ করে জেলির ন্যায় থকথকে আঠালো বর্ণ ধারণ করে এবং আমাদের পাকস্থলীতে যেয়ে বিপাকপ্রক্রিয়ার গতি ধীর করে আনে। ফলে পেট অনেকক্ষণ ভরা থাকে এবং ক্ষুধা কম লাগে।
গবেষণা থেকে প্রমাণিত, দ্রবণীয় খাদ্যআঁশ আমাদের দেহে মেটাবোলিজম বুস্ট করে ওজন কমাতে সাহায্য করে, বিশেষ করে যারা ওভারওয়েইট এবং ওবেসিটিতে আক্রান্ত।
২০০৯ সালের একটি গবেষণায় টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ৭৭ জন স্থুলকায় ব্যক্তিকে ৬ মাসের জন্য চিয়া সিড সমৃদ্ধ সুষম খাদ্যাভ্যাসের রুটিন ফলো করানো হয়।
অপরদিকে, অন্য একটি দলকে শুধুমাত্র প্লেসবো (placebo) গ্রহণের পরামর্শ দেয়া হয়। নির্দিষ্ট সময় পর দেখা যায় যে, চিয়া সিড গ্রহণকারী দলটি প্লেসবো গ্রহণকারী দলের তুলনায় ওজন দ্রুত কমাতে সক্ষম হয়েছেন, এমনকি এই সুষম খাদ্যাভ্যাসটি তাদের টাইপ ২ ডায়াবেটিসে কোনরকম প্রভাবও ফেলেনি।
এছাড়াও, চিয়া সিডের প্রোটিন আমাদের ক্ষুধা নিবারণ এবং অতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণের প্রবণতা কমিয়ে আনে। পাবমেড সেন্ট্রাল (PubMed Central) কর্তৃক প্রকাশিত একটি গবেষণায় দুইটি পৃথক দলকে দুইরকম খাবার প্রাতঃরাশে দেয়া হয়। প্রথম দলকে ৭ গ্রাম চিয়া সিড প্রতিদিন টকদইয়ের সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়, এবং ২য় দলকে চিয়া সিড ছাড়া শুধু টকদই খেতে দেয়া হয়।
কয়েকদিন ব্যাপী চলা এই গবেষণা শেষে দেখা যায় যে, যারা প্রাতঃরাশে শুধুমাত্র টকদই খেয়েছেন তাদের তুলনায় যারা টকদই এবং চিয়া সিডের মিশ্রণ খেয়েছেন তারা তুলনামূলকভাবে অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণের প্রবণতা কমিয়ে আনতে পেরেছেন এবং অল্পেই পূর্ণতা পেয়েছেন।
সুতরাং দেহের অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে সুস্থ থাকার জন্য চিয়া সিডের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তবে অবশ্যই ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ নিয়ে সুষম খাদ্যাভ্যাসের সঠিক নিয়ম মেনেই তা ডায়েট চার্টে যোগ করতে হবে।
৪। হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়
চিয়া সিডে বিদ্যমান দ্রবণীয় ফাইবার এবং ওমেগা -3 এর আধিক্য হৃদযন্ত্রের সুস্থতা নিশ্চিত করে। আমাদের রক্তে LDL অর্থাৎ খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে গেলে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। চিয়া সিডে থাকা খাদ্যআঁশ এই LDL এর মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। ফলশ্রুতিতে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে।
সাধারণত LDL এর পাশাপাশি রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইড (triglyceride) এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেস লেভেল (oxidative stress level) এর আধিক্যও হৃদরোগের জন্য দায়ী। চিয়া সিডে বিদ্যমান ALA নামক ওমেগা -3 ফ্যাটি এসিড এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং হৃদযন্ত্রের সুস্থতা নিশ্চিত করে। এছাড়াও যারা উচ্চরক্তচাপের রোগী, তাদের জন্যও চিয়া সিড বেশ উপকারী বলে গবেষণায় এসেছে।
তবে চিয়া সিডের বহুমুখী ভূমিকার সত্যতা নিশ্চিতকরণের জন্য আরো গবেষণার প্রয়োজন বলে ধারণা করেন বিশেষজ্ঞরা।
৫। রক্তে শর্করার মাত্রা হ্রাস করে
রক্তে শর্করার হার বৃদ্ধি পেলে হৃদরোগ, স্ট্রোকসহ বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বাড়ে। চিয়া সিডে থাকা ফাইবার এবং অন্যান্য উপকারী অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলোর কারণে আমাদের দেহে ইনসুলিনের সংবেদনশীলতার হার নিয়ন্ত্রিত থাকে এবং খাবারের পর রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল হয়। বিশেষ করে যারা টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তাদের জন্য চিয়া সিড বেশ উপকারী বলে ধারণা করা হয়।
২০১০ এবং ২০১৩ সালের দুটো গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, যারা চিয়া সিড ব্যতীত আটার রুটি খান তাদের তুলনায় যারা চিয়া সিড যুক্ত আটার রুটি খান তাদের দেহে রক্তের শর্করার হার তুলনামূলকভাবে কম।
পাবমেড সেন্ট্রাল (PubMed Central) থেকে প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, ২০১৭ সালে ১৫ জনের উপর চালানো একটি ছোট্ট গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, তিসির বীজের তুলনায় চিয়া সিড দেহে গ্লুকোজ নিঃসরণের মাত্রা কমিয়ে দেয় এবং যেকোন কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার গ্রহণের পরে রক্তে শর্করার প্রভাব হ্রাস করে।
৬। হাড়ের সুস্থতা নিশ্চিত করে
চিয়া বীজে বিদ্যমান ALA, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস এবং ম্যাগনেসিয়াম সহ হাড়ের সুস্বাস্থ্যের জন্য বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পুষ্টি উপাদান রয়েছে, যা বোন মিনারেল ডেনসিটি (bone mineral density) নিশ্চিত করে। উল্লেখ্য, বোন মিনারেল ডেনসিটি সুস্থ ও মজবুত হাড়ের একটি সূচক হিসেবে চিকিৎসাবিজ্ঞানে পরিচিত।
গবেষণায় এসেছে যে, চিয়া সিডে ক্যালসিয়ামের হার দুগ্ধজাত খাদ্যদ্রব্যের চেয়েও বেশি (দৈনন্দিন চাহিদার প্রায় ১৮%)। তাই একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনন্দিন ক্যালসিয়ামের ঘাটতি পূরণে চিয়া সিড হতে পারে একটি অন্যতম উৎস।
৭। সুষম খাদ্যাভ্যাসে সহায়ক
দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততার কারণে সুষম খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের পক্ষে সম্ভবপর হয়ে উঠে না। তাই যারা নিজেদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন, তারা দৈনন্দিন ডায়েটে চিয়া সিড নিঃসন্দেহে যোগ করতে পারেন।
চিয়া সিড দিয়ে স্বাস্থ্যকর রেসিপি তৈরি করা যেমন সহজ, তেমনি এটি ব্যবহার করা যায় যেকোন কিছুতেই। খুব সহজে পানি শোষণ করে নেয় বলে যেকোন জুস, স্মুদি, পুডিং ইত্যাদি তরল খাবারে চিয়া সিডের ব্যবহার বেশ প্রচলিত।
চিয়া সিড খাওয়ার অপকারিতা
১। বদহজম সংক্রান্ত সমস্যা: চিয়া সিডে খাদ্যআঁশের পরিমাণ বেশি থাকায় মাত্রাতিরিক্ত খেয়ে ফেললে কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া, বদহজম বা গ্যাসের সমস্যা এমনকি অন্ত্রের প্রদাহের জন্যও দায়ী হতে পারে।
২। দম বন্ধ হওয়া এবং শ্বাসকষ্ট: শুকনো চিয়া সিড অসাবধানতাবশত গলায় আটকে শ্বাসরোধের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই ব্যবহারের অন্তত ৫-১০ মিনিট আগে থেকে এগুলো ভিজিয়ে রাখা প্রয়োজন।
৩। অ্যালার্জি: যাদের চিয়া সিডে অ্যালার্জি আছে, তারা ভুলবশত চিয়া সিড খেয়ে ফেললে বমি, ডায়রিয়া বা জিহবায় চুলকানি ভাব হতে পারে, যা থেকে অ্যানাফিল্যাক্সিস (anaphylaxis) হওয়াও অসম্ভব কিছু নয়। তাই চিয়া সিড খাওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে টেস্ট করানো জরুরি।
৪। রক্তের ঘনত্ব হ্রাস: চিয়া সিডের ওমেগা-৩ এর আধিক্য রক্ত পাতলা করার পাশাপাশি যেকোনো ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
৫। অন্যান্য শারীরিক জটিলতা: যারা ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের ঔষধ সেবনে অভ্যস্ত, তারা অতিরিক্ত মাত্রায় চিয়া সিড খেলে দেহে শর্করার মাত্রা অস্বাভাবিক হারে হ্রাস পায়, যা বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদী ও আকস্মিক শারীরিক জটিলতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
চিয়া সীড বা বীজের দাম
প্রতি কেজি চিয়া সিডের দাম ৭০০ টাকা থেকে ৮৫০ টাকা। তবে যদি আপনি কম পরিমাণে কিনতে চান, তাহলে প্রতি ১০০ গ্রাম চিয়া সিড এর দাম হবে ৮০ থেকে ১০০ টাকা।
চিয়া সিড এখনো লোকাল মার্কেটে কিছুটা অপ্রচলিত। তবে ভালো অর্গানিক শপ এবং অনলাইন মার্কেটগুলোতে চিয়া সিড অর্ডার করতে পারবেন।
চিয়া সিড খাওয়ার নিয়ম নিয়ে শেষ কথা
আশা করি চিয়া সিড খাওয়ার নিয়ম এবং চিয়া সিড এর উপকারিতা গুলো সম্পর্কে আমরা আপনাকে সঠিকভাবে বুঝাতে পেরেছি।
যদিও চিয়া সিডের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে আরো গবেষণা দরকার বলে মনে করেন স্বাস্থ্যবিদরা, তবুও যারা স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হতে চান, তারা চিয়া সিডকে সুষম খাদ্যাভ্যাসে যুক্ত করে নিতে পারেন নিশ্চিন্তেই। কেননা আমাদের দৈনন্দিন কর্মব্যস্ত জীবনে সুস্থতা নিশ্চিত করতে চিয়া সিডের বিকল্প মেলা ভার।
ধন্যবাদ অনেক।
আপনাকেও ধন্যবাদ সময় করে পড়ার জন্য