আমাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর মধ্যে কিডনি বা বৃক্ক (Kidney) অন্যতম হলেও কিডনি ভালো রাখার উপায় নিয়ে আমরা না খুব একটা সিরিয়াস না। এমনকি আমরা কিডনি ভালো রাখার চেষ্টা পর্যন্ত করি না। অথচ, কিডনি দেহের রেচনতন্ত্রের প্রধান অংশ। কিডনি প্রধানত রক্ত ছেঁকে বর্জ্য পদার্থ আলাদা করে এবং মূত্র উৎপাদন করে। কারো কিডনি বিকল হয়ে পড়লে মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হন, এমনকি মৃত্যুও ঘটতে পারে।
আমাদের দেহের অভ্যন্তর ভাগে উদর গহ্বরের পশ্চাৎদিকে মেরুদণ্ডের দুই পাশে দুটি বৃক্ক বা কিডনি অবস্থিত যা দেখতে অনেকটা শিমের মত এবং বাদামী রঙের। কিডনি ১৫০ – ১৭০ গ্রাম (পুরুষ) এবং ১৩০ – ১৫০ গ্রাম (মহিলা) ওজনের হয়ে থাকে।
কিডনি সুস্থ সবল রাখতে কিডনি ভালো আছে কিনা বোঝার উপায়গুলো অবশ্যই জানা থাকতে হবে এবং কিডনি ভালো রাখার উপায়, কিডনি ভালো রাখার খাদ্য ও অন্যান্য আনুসাঙ্গিক বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া জরুরী।
একনজরে সম্পূর্ণ আর্টিকেল
কিডনি রোগের কারণ
কিডনি রোগের পিছনে অনেক কারণ থাকতে পারে, যেমন:
- টাইপ ১ বা টাইপ ২ ডায়াবেটিস
- উচ্চ রক্তচাপ (High blood pressure)
- পলিসিস্টিক কিডনি রোগ (Polycystic kidney disease)
- কিডনিতে পাথর হওয়া (Kidney Stone)
- গ্লোমেরুলোনফ্রাইটিস (Glomerulonephritis)
- ইন্টারস্টিশিয়াল নেফ্রাইটিস (Interstitial nephritis)
- ক্যান্সার
- মূত্রথলির প্রদাহ
- বংশগত কিডনি রোগ
- বয়স জনিত কিডনির সমস্যা
- প্রোস্টেট গ্রন্থি বড় হয়ে যাওয়া
- পাইলোনেফ্রাইটিস (Pyelonephritis)
- মূত্রথলিতে পাথর
কিডনি রোগের লক্ষণ | কিডনি ভালো আছে কিনা বোঝার উপায়
কিডনি রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে যেসব লক্ষণ দেখা যায়:
- বমি বমি ভাব
- খাদ্যে অরুচি বা ক্ষুধামন্দ্য
- শুষ্ক ত্বক এবং ত্বকে চুলকানি
- মাথা ব্যথা
- ক্লান্তিভাব
- ওজন কমে যাওয়া
- ঘন ঘন প্রস্রাবের চাপ আসা
কিডনিতে কোনো রোগ হয়ে যাওয়ার পর যেসব লক্ষণ দেখা দেয়:
- কিডনি রোগে রক্তে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের মাত্রার তারতম্য হওয়ায় শরিরের বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যথা অনুভব হয়।
- শরীরে পানি জমে যায় যার ফলে পায়ের গোড়ালি, পা এবং হাঁটু ফুলে যায়।
- শরীরে বর্জ্য পদার্থ জমে যাওয়ার ফলে দুর্গন্ধযুক্ত প্রস্রাব হয়।
- বমি হয়।
- প্রস্রাবের মাত্রা বৃদ্ধি পায়।
- মলমূত্রের সাথে রক্তক্ষরণ হয়।
- মাংসপেশির অস্বাভাবিক সংকোচন।
- ঘনঘন তৃষ্ণা পাওয়া।
- কিছুক্ষেত্রে ঋতুস্রাবও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
- অনিদ্রা বা ঘুমে ব্যঘাত।
- শরীরের ত্বকের রং পরিবর্তন হওয়া।
- যৌন অক্ষমতা।
কিডনি ভালো রাখার উপায়
১. পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করুন
কিডনি ভালো রাখতে প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করলে কিডনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়, কিডনির স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় থাকে।
২. স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন
ভাজা খাবারের তুলনায় সেদ্ধ খাবার ভালো। বেকড খাবার খেতে পারেন। যতটা সম্ভব বাড়তি তেল চর্বি জাতীয়, ট্রান্সফ্যাট, স্যাচুরেটেড ফ্যাটসমৃদ্ধ খাবার এড়িয়ে চলুন। পরিশোধিত (রিফাইনড – Refined) খাবার এড়িয়ে চলুন। গোটা শস্যের (Whole grain) খাদ্যশস্য বেছে নিন। খাবার আস্তে আস্তে উত্তমভাবে চিবিয়ে খান।
ননিবিহীন দুধ খাওয়ার অভ্যাস করুন, এটি কিডনি ও শরীরের পক্ষে ভালো। পনির, মেয়োনিজ না খাওয়াই ভালো। চিনি ছাড়া বা কম চিনি দেওয়া খাবার গ্রহণ করুন।
অতিরিক্ত প্রাণিজ প্রোটিন খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। গরুর মাংস অথবা এই জাতীয় প্রাণিজ আমিষ অতিরিক্ত খেলে কিডনির উপর চাপ পড়ে।
৩. অতিরিক্ত লবণ পরিহার করুন
পরিবারের সকলের কিডনি ভালো রাখার জন্য খাবারে অতিরিক্ত লবণ দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। অনেকেরই খাবারের সাথে আলাদা করে লবন খাওয়ার অভ্যাস আছে, এই অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে।
একজন সুস্থ ব্যক্তি দৈনিক ৫-৬ গ্রাম লবণ গ্রহণ করতে পারবেন। এরচেয়ে বেশিই তরকারিতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তাই আলাদা করে খাবারে কাচা লবন খাবেন না।
৪. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন
শরিরের অতিরিক্ত ওজন কিডনি রোগের ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়। তাই, কিডনি ভালো রাখার উপায় হলো ওজন কমানো। আপনার বিএমআই ২৩-২৪ এর মাঝে রাখতে ওজন কমানোর চেষ্টা করুন।
৫. মাদক ত্যাগ করুন
ধূমপান ও মদ্যপানের ফলে কিডনিতে রক্ত চলাচল কমে যেতে পারে। এতে করে কিডনির কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। ধূমপান, পান জর্দা, অ্যালকোহল এসব সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করতে হবে। এসব গ্রহণের কারনে ক্যান্সারের ঝুঁকিও বাড়ে।
৬. ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন
কিডনি রোগীদের একটা বড় অংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। অনিয়ন্ত্রিত এবং দীর্ঘদিনের ডায়াবেটিসের ফলে কিডনি বিকল হতে পারে।
ডায়বেটিসের প্রভাব কিডনিতে পড়তে পারে। নিয়মিত রক্তের সুগার লেভেল পরীক্ষা করুন এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করুন।
রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে কিডনির জটিলতা এড়ানো সম্ভব। পাশাপাশি ডায়াবেটিস রোগীদের নিয়মিত কিডনি পরীক্ষা করা ভালো। কিডনিতে কোনো জটিলতা বা সমস্যা হচ্ছে কিনা তা বোঝার জন্য রক্তে সিরাম ক্রিয়েটিনিন (Serum creatinine) এবং প্রস্রাবের আমিষ পরীক্ষা করতে হবে (৬ মাস পর পর বা বছরে একবার)।
৭. কোমল পানীয় পরিহার করুন
কোমল পানীয় (Soft drinks) বা এনার্জি ড্রিংকস (Energy Drink) কিডনির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। কিডনি সুস্থ্য রাখতে এসব পানীয় যতটা কম খাওয়া যায় শরীরের জন্য ততই ভালো।
৮. প্রয়োজনের বেশি ভিটামিন সি খাওয়া যাবে না
আমাদের শরিরে প্রতিদিন ৫০০ মিলি গ্রাম ভিটামিন সি-এর প্রয়োজন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভিটামিন সি যুক্ত খাবার খেলে কিডনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৯. রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখুন
স্বাভাবিকের তুলনায় রক্তচাপ অতিরিক্ত বেড়ে গেলে কিডনির সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই, উচ্চ রক্তচাপ কমানোর উপায় জেনে নিন এবং রক্তচাপ ঠিক রাখুন।
১০. ওষুধ সেবনে বিশেষভাবে সতর্ক থাকুন
কমবেশি প্রায় সব ওষুধই কিডনির জন্য ক্ষতিকর। তাই, না জেনে বুঝে কোনো ওষুধ গ্রহণ করবে না। অনেকে হারবাল, ভেষজ উপাদান আমরা নিজেরা ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খেয়ে থাকি। কিন্তু এটি প্রকৃতপক্ষে আমাদের কিডনি সমস্যার কারণ হয়ে দাড়ায়। তাই, কিডনি ভালো রাখতে ওষুধ গ্রহণের পূর্বে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করবেন।
১১. কিডনি ভালো রাখতে নিয়মিত ব্যায়াম করুন
কিডনি ভালো রাখার উপায়গুলোর মাঝে অন্যতম কার্যকরি হলো নিয়মিত ব্যায়াম করা। ব্যায়াম করলে কিডনি রোগের ঝুঁকি কমে যায়। কিডনি ভালো রাখার জন্য হাঁটা, দৌড়ানো, সাইকেল চালানো, ফ্রি-হ্যান্ড ব্যায়াম সহ সহজ কিছু ব্যায়াম ও যোগাসন করতে পারেন।
কিডনি ভালো রাখার খাদ্য
১) ফুলকপি: ফুলকপিতে রয়েছে ফোলেট ও খাদ্য আঁশ যা কিডনি ভালো রাখতে সহায়তা করে। এতে আরো রয়েছে উচ্চমাত্রায় ভিটামিন সি যা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ইউরিনারি সিস্টেম (Urinary system) ভালো রাখতে সহায়তা করে। ফুলকপিতে সোডিয়াম, পটাসিয়াম ও ফসফরাস আছে কিন্তু নিম্নমাত্রায় তাই কিডনির ওপর চাপ কম পড়ে এবং কিডনি সুস্থ সবল থাকে।
২) রসুন: রসুনে রয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মিনারেল, যেমন- সোডিয়াম, ফসফরাস ও পটাশিয়াম। এই মিনারেলস অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি (Anti inflammatory) হিসেবে কাজ করে। রসুন রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে রক্ত সঞ্চালনে সহায়তা করে। প্রতিদিন খালি পেটে ১ কোয়া রসুন খাওয়ার অভ্যাস করতে পারলে কিডনির রোগ থেকে মুক্তি পাবেন।
৩) আনারস: আনারসে উচ্চ মাত্রায় ফাইবার থাকে যা কিডনির রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। এছাড়াও, আনারসে রয়েছে প্রচুর পরিমানে ম্যাঙ্গানিজ, ভিটামিন সি এবং ব্রোমেলিন যা প্রদাহজনিত সমস্যা হ্রাস করতে সহায়তা করে।
৪) ক্যাপসিকাম: ক্যাপসিকাম অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ভিটামিন সি সমৃদ্ধ একটি খাদ্য। তাই, কিডনি ভালো রাখতে ক্যাপসিকাম অতি প্রয়োজনীয়।
৫) ডিমের সাদা অংশ: কিডনি সুস্থ্য রাখতে ডিমের সাদা অংশের প্রোটিন বেশ কার্যকর খাদ্য। তাই, কিডনি ভালো রাখার জন্য খাদ্য তালিকায় ডিমের সাদা অংশ অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন।
৬) লাল আঙুর: লাল আঙুরে রয়েছে ফ্লাভনয়েড যা রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক রাখে এবং ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। এতে রয়েছে ভিটামিন সি ও অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, যা কিডনির রোগ দূর করে।
৭) আপেল: আপেল খাওয়ার প্রচুর উপকারিতা রয়েছে। প্রতিদিন একটি করে আপেল খাওয়ার অভ্যাস করুন, এটি কিডনির স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় রাখতে সাহায্য করবে।
৮) মাছ: মাছ প্রোটিনের অন্যতম একটি উৎস। মাছে রয়েছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, যা কিডনি ভালো রাখতে সহায়ক। ওমেগা-৩ যুক্ত খাবার কিডনির জন্য ভালো।
৯) জাম: জামে থাকা অ্যান্টি অক্সিডেন্ট কিডনির জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ।এতে সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস আছে যা কিডনি ভালো রাখে। নিয়মিত কালো জাম খেলে ওবেসিটি (Obesity), ডায়াবেটিস (Diabetes), হাইপার টেনশন সহ (Hypertension) নানান রোগের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারেন।
১১) পেঁয়াজ: পেঁয়াজে রয়েছে প্রচুর পরিমানে ফ্লাভনয়েড। ফ্লাভনয়েড রক্তনালীতে চর্বি জমতে দেয় না। এর অ্যান্টি অক্সিডেন্ট কিডনি ভালো রাখতে বিশেষ ভুমিকা রাখে।
১২) হলুদ: নিয়মিত হলুদ খেলে কিডনি পরিষ্কার হয়। এতে থাকা অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান কিডনি রোগ থেকে দূরে রাখে ও কিডনিতে পাথর জমা হওয়া রোধ করে।
১৩) লেবু: প্রতিদিন লেবু মেশানো পানি খেলে কিডনি পরিষ্কার থাকে। লেবুতে রয়েছে সাইট্রিক এসিড যা কিডনিতে জমা হওয়া পাথর ভাঙ্গতে সক্ষম। লেবুতে বিদ্যমান সাইট্রাস উপাদান কিডনিতে থাকা ক্রিস্টালগুলোকে পরস্পরের জোড়া লাগতে বাধা দেয়।
১৪) আদা: কিডনির কার্যকারিতা বাড়াতে ও কিডনি ভালো রাখতে আদা খেতে পারেন। আদা কিডনিতে রক্ত চলাচল বাড়িয়ে কিডনিকে সচল রাখতে সাহায্য করে।
১৫) বাঁধাকপি: কিডনির সমস্যা প্রতিরোধে বাধাকপি একটি অপরিহার্য সবজি। বাধাকপিতে ভিটামিন সি রয়েছে। বাধাকপি আঁশজাতীয় হওয়ায় এটি অন্ত্রের গতিবিধি ঠিক রাখে, পাচনতন্ত্রকে সুস্থ্য রাখে।
কিডনি ভালো রাখার উপায় নিয়ে শেষ কথা
কিডনি আমাদের দেহের অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কেননা, কিডনি রক্ত ছেঁকে বর্জ্য পদার্থ আলাদা করে, মূত্র উৎপাদন করে শরীরকে বিষাক্ত পদার্থ থেকে মুক্ত করে, দেহে পানি ও তড়িৎবিশ্লেষ্য পদার্থ বা ইলেকট্রোলাইট (Electrolyte) যেমন সোডিয়াম, পটাসিয়াম ইত্যাদির ভারসাম্য বজায় রাখে, রক্তের pH নিয়ন্ত্রণ করে বা অম্ল-ক্ষারের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।
সাধারণত কিডনি রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে না। যখন ধরা পড়ে তখন দেরি হয়ে যায় এবং সেই সময়ে চিকিৎসা করা কঠিন এবং ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। তাই আমাদের উচিত, নিয়ম করে কিডনি ভালো রাখার খাদ্য গ্রহণ করা এবং নিয়মিত ৬ মাস বা ১ বছর পর পর কিডনি পরীক্ষা করা।
আশা করি, কিডনি ভালো রাখার উপায় সম্পর্কে লেখা আর্টিকেলটি থেকে কিডনি রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। যা আপনার কিডনি সুস্থ্য রাখতে কাজে আসবে।