হেপাটাইটিস বি একটি মারাত্মক সংক্রামক রোগ, যা আমাদের লিভার কে প্রভাবিত করে। হেপাটাইটিস বি কেন হয় এবিষয়ে আমরা অনেকেই জানিনা। অথচ, হেপাটাইটিস বি কি, কেন হয়, প্রতিরোধের উপায় জানা থাকলে মারাত্মক এই রোগ থেকে বেঁচে যাওয়া সম্ভব।
হেপাটাইটিস বি ভাইরাস আমাদের শরীরে রক্ত কিংবা দেহ নিঃসৃত তরলের মাধ্যমে প্রবেশ করতে পারে। সমস্যা হলো, হেপাটাইটিস বি রোগটি মারাত্মক রূপ নেওয়ার আগে রোগী আগে থেকে কিছু বুঝতে পারেন না।
শিশুদের মধ্যে হেপাটাইটিস বি সবচেয়ে বেশি দেখা দেয়। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সারা বিশ্বে প্রতিবছর ২ থেকে ৫ লাখ শিশু হেপাটাইটিস বি ভাইরাস রোগে আক্রান্ত হয়ে জন্মগ্রহণ করে। তারাই পরবর্তীতে এর বাহক হয়।
আমরা অনেকে হয়তো এখনো হেপাটাইটিসবি সম্পর্কে জানি না। হেপাটাইটিস বি কেন হয়, হেপাটাইটিস বি ভাইরাস কিভাবে ছড়ায়, হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর লক্ষণ কিংবা প্রতিকারের উপায় ও চিকিৎসা সম্পর্কে আমরা বেশিরভাগ মানুষই জ্ঞান রাখি না। তাই, আসুন আজ হেপাটাইটিস বি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক-
একনজরে সম্পূর্ণ আর্টিকেল
হেপাটাইটিস বি কি | What is Hepatitis B
হেপাটাইটিস বি মূলত আমাদের যকৃত বা লিভার কে আক্রমণ করে। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের আক্রমণে এই রোগ হয়। এটিকে সিরাম হেপাটাইটিস-বি ও বলা হয়।
হেপাটাইটিস বি ভাইরাস সাধারণত পাঁচ ধরনের যেমন-
- হেপাটাইটিস এ
- হেপাটাইটিস বি
- হেপাটাইটিস সি
- হেপাটাইটিস ডি এবং
- হেপাটাইটিস ই।
হেপাটাইটিস এর বিভিন্ন প্রকারভেদের মাঝে বি ভাইরাস অন্যতম শক্তিশালী। বি এবং সি ভাইরাস দ্বারা মানুষ সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত হয়।
হেপাটাইটিস বি ভাইরাস আক্রান্তদের বেশিরভাগই প্রাথমিকভাবে কোন লক্ষণ প্রকাশ পায় না। এটি ধীরে ধীরে আমাদের লিভার ক্যান্সারের দিকে ঠেলে দেয়। কিছু মানুষের মধ্যে Hepatitis B Virus দীর্ঘসময় ধরে সিপ্ত অবস্থায় থাকে, আক্রান্ত রোগী কিছুই বুঝতে পারেন না। এই লুকায়িত ভাইরাসকে ক্রনিক হেপাটাইটিস বলা হয়।
প্রতিবছর ৭.৫ লাখের বেশি মানুষ এই ভাইরাসের কারণে মারা যান। তার মধ্যে বেশিরভাগ মারা যান যকৃতের ক্যান্সার এ আক্রান্ত হয়ে।
হেপাটাইটিস বি কেন হয় | Why Hepatitis B Occurs
হেপাটাইটিস এমন একটি রোগ যা Hepatitis B ভাইরাসের মাধ্যমে আমাদের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। হেপাটাইটিস বি বিভিন্নভাবে হয়ে থাকে। তবে হেপাটাইটিস বি তরল পদার্থের সংস্পর্শের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ছড়ায়।
হেপাটাইটিস বি কেন হয় সেসম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক:
১. সংক্রমিত কোন ব্যক্তির ব্যবহৃত ব্লেড বা সূচ ব্যবহার করার ফলে আমাদের শরীরে এই বি ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে পারে।
২. সন্তান প্রসবের সময় সংক্রমিত মায়ের থেকে তার শিশুর Hepatitis B হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। মা থেকে সন্তানের এই ভাইরাস হতে পারে।
৩. সংক্রমিত ব্যক্তির ব্যবহৃত যেকোনো জিনিস যেমন ব্লেড, টুথব্রাশ, টাওয়াল ইত্যাদি এবং তার সংস্পর্শে আসলে হেপাটাইটিস-বি হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
৪. শরীরে ট্যাটু অংকন করে এমন ব্যক্তি যদি আগে থেকে এই ভাইরাসে আক্রান্ত থাকে তাহলে তার ব্যবহৃত যন্ত্র দ্বারা ও ব্যক্তি এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়।
৫. হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের কোনো রোগীর রক্ত যদি অন্য কোন ব্যক্তি গ্রহণ করে থাকে সে ক্ষেত্রে তার শরীরে ও এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে।
৬. যে সকল ব্যক্তি মাদক গ্রহণ করে তাদের ব্যবহার করা সূচ বা সিরিন্স, এমনকি তাদের থুতু, প্রস্রাব, বীর্য ইত্যাদি এগুলোর মাধ্যমে hepatitis b ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তি তে ছড়িয়ে পড়ে।
৭. অসুরক্ষিত যৌনতার মাধ্যমেও এই রোগ ছড়ায়। যারা একাধিক শারীরিক সম্পর্কে জড়ান তাদের মধ্যে মহামারীর মত এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে।
৮. আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে বসবাস কিম্বা এই রোগে সংক্রমণের হার বেশি এমন কোন স্থানে ভ্রমণ করলেও এই রোগ ছড়াতে পারে।
৯. সার্জিকাল বিষয় এর মাধ্যমে অথবা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দানের মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার ঘটাতে পারে।
হেপাটাইটিস বি এর লক্ষণ সমূহ | Hepatitis B Symptoms
প্রাথমিকভাবে হেপাটাইটিস বি রোগের কোন লক্ষণ প্রকাশ পায় না। অনেক সময় এত পরে লক্ষণ দেখা দেয় যে, লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পর পরই রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সংক্রমিত হওয়ার পর লক্ষণ প্রকাশ পেতে ৩০ থেকে ১৮০ দিন পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে।
আমাদের মধ্যে যে সকল ব্যক্তি দীর্ঘস্থায়ী HBsAg-তে আক্রান্ত তাদের বেশিরভাগেরই কোনো লক্ষণ থাকে না। সেক্ষেত্রে রোগী ধীরে ধীরে সিরোসিস এবং যকৃতের ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে কিছু লক্ষণ কে হেপাটাইটস বি এর লক্ষণ হিসেবে ধরা হয়।
হেপাটাইটিস বি এর লক্ষণ সমূহ:
- এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে রোগী অতিরিক্ত ক্লান্তি অনুভব করবে।
- বমি ভাব হওয়া বা বমি হওয়া এবং পেট ব্যথা করা এই সকল লক্ষণ দেখলে Hepatitis B ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ হিসেবে ধরা হয়।
- ত্বক ও চোখ হলদে হয়ে যাওয়া ও হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের লক্ষণ।
- Hepatitis B তে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রস্রাব লাল ও গাড় রঙের হয়ে থাকে।
- সেই সাথে রোগীর শরীরে অতিমাত্রায় জ্বর, মাথাব্যথা, পেশি ও গ্রন্থি ব্যথা থাকতে পারে।
- আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের বিভিন্ন জায়গায় চুলকানি বা র্যাশ দেখা দিতে পারে।
উপরে উল্লেখিত হেপাটাইটিস বি এর লক্ষণ সমূহ কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। মূলত এই লক্ষণগুলো দেখা দেয় ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার প্রথম ছয় মাসের মধ্যে।
হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধের উপায়
বিভিন্ন ধরনের হেপাটাইটিস ভাইরাস এর মধ্যে আমাদের হেপাটাইটিস এ এবং বি ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য টিকা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। বি ভাইরাসের টিকা নেওয়াটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
কারণ, বি ভাইরাসে আক্রান্ত হলে আমাদের দীর্ঘমেয়াদী ক্রনিক লিভার ডিজিজ হওয়ার ঝুঁকি থাকে। যকৃতের স্বাভাবিক কর্ম ক্ষমতা কমতে শুরু করে। সেক্ষেত্রে যকৃৎ পুরোপুরি অকেজো হয়ে অকাল মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
তাই এখনো বি ভাইরাসের টিকা গ্রহণ না করে থাকলে এসব জটিলতা এড়াতে দ্রুত Hepatitis B Virus এর টিকা নিয়ে নিন। আপনার শরীরে একবার ভাইরাসটির বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে গেলে আজীবন হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধ করতে পারবেন।
এখন অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধের টিকা কোন বয়সের মানুষেরা নিতে পারবেন এবং এটি কত ডোজ নিতে হবে। তাহলে এখন এই বিষয়ে জেনে নিন-
ক) জন্মের প্রথম দিন থেকে ৭০ বছর বয়স্ক যে কেউ এই টিকা নিতে পারবেন। তবে টিকা গ্রহণের আগে ইতিমধ্যেই এই ভাইরাসে আক্রান্ত কিনা তা জেনে নিতে হবে। এটি রক্ত পরীক্ষা করার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে নিবেন।
খ) প্রথম ডোজ টিকা নেওয়ার একমাস পর দ্বিতীয় ডোজ দিবেন। এরপর প্রথম ডোজ নেওয়ার দিন থেকে ছয় মাস পর তৃতীয় টিকা নিতে হয়।
গ) তিনটি ডোজ সম্পন্ন হওয়ার পর পুনরায় রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে যে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে আপনার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠেছে কিনা। যদি পর্যাপ্ত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা না গড়ে ওঠে তাহলে ৫ বছর পর চতুর্থ ডোজ টিকা নিতে হবে। যেটাকে বলা হয় বুস্টার ডোজ।
ঘ) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে শিশুর জন্মের প্রথম দিনেই এই টিকা দিয়ে নেওয়া উচিত। এই ভাইরাস থেকে সম্পূর্ণ সুরক্ষার জন্য দুই থেকে তিনটি ডোজ নেওয়া প্রয়োজন। কারণ ৯৫% ক্ষেত্রেই এই টিকা আমাদের শরীরে কাজ করে।
যে সকল ব্যক্তি হেপাটাইটিস বি এর টিকা নিতে পারবেন না
- যারা আগেই Hepatitis B ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি এই টিকা নিতে পারবেন না।
- গর্ভবতী নারীকে তার গর্ভাবস্থায় টিকা দেওয়া হয় না।
- প্রথম ডোজ নেওয়ার পর যাদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে এবং শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের পরবর্তী ডোজ গুলো আর দেওয়া হয়না।
হেপাটাইটিস বি এর চিকিৎসা
Hepatitis B ভাইরাসে প্রতিবছর অনেক মানুষ আক্রান্ত হন। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে উদ্বিগ্ন না হয়ে আগে ভালো কোনো চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। Hepatitis B এর চিকিৎসা সাধারণ দুইভাবে করা হয়।
- মুখে খাওয়ার ওষুধের মাধ্যমে
- ইনজেকশনের মাধ্যমে
প্রথমে রোগীকে পরীক্ষা করে তার ওপর ভিত্তি করে ৬ মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত খাওয়ার ওষুধ দেওয়া হয়। এর পর পুনরায় পরীক্ষা করতে বলা হয়। অনেকেই ৬ মাসের মধ্যে ভালো হয়ে যান। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় রোগী যদি সঠিকভাবে চিকিৎসা নেন তাহলে এই রোগ থেকে পরিপূর্ন নিরাময় হয়ে যায়।
তবে কিছু রোগের ক্ষেত্রে এটি নেগেটিভ হয় না। এতে ভয়ের কিছু নেই। রোগী যদি নিয়মিত চিকিৎসকের ফলোআপে আসেন তাহলে এই রোগ থেকে সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে রোগী ছয় মাসের মধ্যে ভালো হয়ে যায়।
এছাড়াও হেপাটাইটিস বি ভাইরাস প্রতিরোধ করার বেশ কিছু উপায় রয়েছে। যেগুলো মেনে চললে এই রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
- সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবেন।
- অন্যের ব্যবহারকৃত জিনিস নিজে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।
- ড্রাগ গ্রহণ না করা।
- ভ্যাকসিন না থাকলে দ্রুত ভ্যাকসিন নিয়ে নিন।
- দাঁতের চিকিৎসার ক্ষেত্রে অবশ্যই জীবাণুমুক্ত সরঞ্জামাদি ব্যবহার করার দিকে খেয়াল রাখুন।
- মা হতে সন্তানের এই রোগ খুব সহজে হতে পারে। তাই গর্ভকালীন চেকআপ এর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। মায়ের আগেই ভ্যাকসিন দেওয়া থাকলে সমস্যা নেই। তবে মায়ের যদি হেপাটাইটিস থাকে সে ক্ষেত্রে শিশু জন্মের ১২ ঘণ্টার মধ্যে ভ্যাকসিন নিয়ে নিবেন।
- হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য সূচ, সিরিঞ্জ একজন ব্যক্তিকে ব্যবহার করতে দিতে হবে এবং একবার ব্যবহারের পরে নষ্ট করে ফেলা উচিত।
- রক্ত দেওয়া বা নেওয়ার আগে অবশ্যই পরীক্ষা করে নিবেন।
- অবৈধ যৌন সম্পর্ক থেকে বিরত থাকতে হবে।
এই বিষয়গুলো মেনে চললে Hepatitis B ভাইরাস প্রতিরোধ করা সম্ভব।
হেপাটাইটিস বি কেন হয় সেবিষয়ে শেষ কথা
হেপাটাইটিস বি লিভারের এমন একটি রোগ, যা আমাদের লিভারকে ধীরে ধীরে নষ্ট করে দিতে পারে। অনেকেই প্রশ্ন করেন, HBsAg positive হলে কি করনীয় কি? আসলে, আলাদাভাবে এই ভাইরাসের তেমন কোনো চিকিৎসা নেই। হেপাটাইটিস বি ভাইরাস প্রতিরোধই উত্তম উপায়। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের লক্ষণ অনুযায়ী এবং পরীক্ষা করার মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
হেপাটাইটিসের সংক্রমনের ফলে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদি হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের বাহক। যাদের অধিকাংশের লিভার ক্যান্সার ও লিভার অকেজো হয়ে মারা যাওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
তাই নিজে ভ্যাকসিন নিন এবং পরিবারের সকলকে ভ্যাকসিন নিতে বলুন। সচেতনতা অবলম্বন করলে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস থেকে দূরে থাকা সম্ভব।
আশা করি, আমাদের আলোচনা থেকে হেপাটাইটিস বি কি, হেপাটাইটিস বি কেন হয় এবং প্রতিরোধ ও চিকিৎসা নিয়ে একটি ভালো ধারণা পেয়েছেন। তবে, এখনো কোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট করে জানিয়ে দিতে পারেন।