আমাদের সমাজে মানসিক স্বাস্থ্য এর দিকে শারীরিক সুস্থতার মতো গুরুত্ব দেয়া হয়না। কেন দেয়া হয়না হয়তো অনুমানও করতে পারি, এক কথায় বলতে গেলে আমাদের সচেতনতার অভাব এর মূল কারণ। বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে মনের খবর নেয়াটা হয়তো নেহাতই বিলাসিতা অথচ শরীর আর মন একটি আরেকটির উপর নির্ভরশীল।
কিন্তু করোনা মহামারীর কারনে আত্মহত্যার হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় এই সমস্যা নিরসনে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আজকাল লোকে কথা বলতে শুরু করেছে। এক্ষেত্রে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলি যা খুবই আশাব্যঞ্জক।
বর্তমান প্রেক্ষাপটের গুরুত্ব অনুধাবন করেই মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে লিখতে বসা। চলুন, মানসিক স্বাস্থ্যের নানা দিক নিয়ে আলাপ করা যাক।
একনজরে সম্পূর্ণ আর্টিকেল
মানসিক স্বাস্থ্য কি?
বলুন তো, মানসিক স্বাস্থ্য মানে কি আসলে? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা WHO মানসিক স্বাস্থ্যের খুব সুন্দর সঙ্গায়ন করেছে।
মানসিক স্বাস্থ্য হলো এমন একটি অবস্থা যাতে ব্যক্তি তার নিজস্ব দক্ষতা উপলব্ধি করতে পারে, জীবনের স্বাভাবিক চাপের সাথে লড়াই করতে পারে, উৎপাদনশীল এবং ফলপ্রসূভাবে কাজ করতে পারে এবং তার সম্প্রদায়ের জন্য অবদান রাখতে সক্ষম হয় – WHO
মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে রয়েছে:
- ব্যক্তিগত সুস্থতা
- অনুভূত স্ব-কার্যকারিতা
- স্বায়ত্তশাসন
- দক্ষতা
- অন্তর্নির্ভর নির্ভরতা
- এবং অন্যের মধ্যে নিজের বুদ্ধি ও মানসিক সম্ভাবনার আত্ম-বাস্তবায়ন
আপনি কি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত?
শরীরের যত্ন নিতে গেলে যেমন শরীরের কোন অংশের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে সেটি জানতে হয়, ঠিক তেমনি মনের যত্ন নিতে গেলে ব্যক্তি মানসিকভাবে অশান্তিতে রয়েছেন কি না সেটা জানা জরুরী।
মানসিক বিপর্যস্ততা তৈরির কারণ কি?
আমাদের যেকেউ যেকোনো সময় মানসিক অসুস্থতা অনুভব করতে পারেন। মানসিকভাবে অসুস্থতার পিছনে যেসব কারণ থাকে তাদের মধ্যে অন্যতম হলো:
- বায়োলজিক্যাল ফ্যাক্টর যেমন, জেনেটিকাল ও ব্রেইন কেমিস্ট্রি
- যদি পরিবারের কেউ পূর্বে মানসিক অসুস্থ্যতায় ভুগে থাকেন
- লাইফ এক্সপেরিয়েন্স, যেমন ট্রমা বা অপব্যবহারের মতো কোনো ঘটনা
- আরো একটি বড় কারণ হয়ে দাড়িয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মানসিক স্বাস্থ্য
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের জীবনের একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে। সুতরাং, এটিকে এড়িয়ে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা আলোচনা সম্পূর্ণ করা যায় না।
মহামারীতে মানুষের মৃত্যু এবং আক্রান্তের খবর প্রতিনিয়ত আমরা ফেসবুকে পেয়ে থাকি। অনেক সময় এই খবরগুলো আমাদের মানসিকভাবে চাপে ফেলে। তাই বিশেষজ্ঞরা আজকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বর্তমানে অনেকেরই কাজের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। তাই চাইলেও এই মাধ্যমটা বাদ দেয়া যায় না।
সুতরাং, চেষ্টা করবেন মানসিক চাপ বাড়ায়, নিজের মধ্যে অশান্তি বা অস্থিরতা কাজ করে বা এমন কোন খবর বা লেখা এড়িয়ে যেতে এবং অনুসরন করা থেকে বিরত থাকতে।
পারলে হাতে কিছুটা সময় নিয়ে এই সম্পর্কিত পেইজ বা গ্রুপ নির্বাচন করুন এবং নিজের হোমপেইজ থেকে বাদ দিন।
তাছাড়া, কারো কারো লাইফস্টাইল, ছবি, এক্টিভিটিসও আমাদের মানসিক অশান্তির কারণ হয়ে দাড়ায়। তাই আপনার সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন কোনো লোক থাকলে তাকে আনফলো করুন।
মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ
সুতরাং, একজন মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত মানুষের নিম্নোক্ত লক্ষণ দেখা দিতে পারে এবং এ লক্ষণগুলো একজন ব্যক্তির মধ্যে আছে কি না তা খুঁজে বের করে সেই মতো ব্যবস্থা নেয়া আবশ্যক:
- সহজে ধৈর্য্য হারানো
- পরিমিত পরিমাণে ঘুম না হওয়া
- আশেপাশের সবকিছুতেই বিরক্তি বোধ করা
- চিন্তিত ও বিষন্ন থাকা
- আত্মবিশ্বাসের অভাব
- কাজে-কর্মে মনোযোগ হারিয়ে ফেলা।
SuperSensitiveSandi ওয়েবসাইটের মতে, মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বারোটি বাজে অভ্যাস দুঃশ্চিন্তা করার প্রবনতাকে বাড়িয়ে দেয়:
- সকালের নাস্তা না করা
- অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ
- শারীরিক কসরত বা ব্যায়াম না করা
- টিভিতে বা পত্র-পত্রিকার নিয়মিত উদ্বেগজনক খবর দেখা বা পড়া
- অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণ
- যখন তখন ভাজা-পোড়া বা ফাস্ট ফুড ইত্যাদি গ্রহণ
- দুঃশ্চিন্তা করার ব্যাপারটাকে এড়িয়ে যাওয়া অর্থ্যাৎ, আপনি যে অহেতুক চিন্তা করেন এটির পরিবর্তন না করে ভুলে থাকার চেষ্টা করা
- অতিরিক্ত প্যাকেটজাত খাবার গ্রহণ
- অতিরিক্ত মদ্যপান
- পরিমিত পরিমাণে না ঘুমানো
- নিজেকে অন্যের সাথে তুলনা করা
- যথেষ্ট পরিমাণে পানি পান না করা।
মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকির নানাবিধ কারন বলা হলো। এবার মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেয়ার ব্যাপারে কী করা যেতে পারে, সেটি নিয়ে আলোচনা করা যাক।
মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার উপায়
১. প্রাত্যহিক কর্মের পরিবর্তন
অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানসিকভাবে অবসাদ গ্রস্তদের মধ্যে বিশৃঙ্খল জীবন-যাপনের প্রবণতা দেখা যায়। এই ধরনের রুটিন থেকে বেড়িয়ে আসুন।
- সকাল সকাল উঠার অভ্যেস করুন।
- নিজ নিজ ধর্মমতে প্রার্থনা করুন।
- নিয়মিত ব্যায়ামের অভ্যাস গড়ে তুলুন।
- সময়ের কাজ সময়ে করুন।
- জীবন যাপন করুন নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে।
২. হ্যাপিনেস ক্যামিকেলস
আমাদের শরীর এবং মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণকারী অন্যতম চারটি জৈব যৌগ হলো
- ডোমাপিন,
- অক্সিটসিন,
- সেরাটনিন এবং
- এন্ডোরফিন।
এইসব হরমোন আমাদেরকে উৎফুল্ল রাখতে সাহায্য করে। সুতরাং, আমাদের কাজ হবে এই চারটি যৌগের স্বাভাবিক প্রবাহ শরীরে ধরে রাখা। কিন্তু কিভাবে?
themindsjournal.com মতে খুব সহজেই আমরা কাজটি করতে পারি। যেমন:
- পছন্দসই খাবার গ্রহণ, ছোট ছোট অর্জনকে উদযাপন করা, নিজের কাজগুলো সুসম্পন্ন করা ইত্যাদির মাধ্যমে ডোপামিন বৃদ্ধি পায়।
- অক্সিটসিন বা Love Hormone বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলা করলে, প্রিয়জনের হাত ধরলে, অন্যের প্রশংসা করলে, পরিবারের সদস্যদের জড়িয়ে ধরলে বৃদ্ধি পায়।
- নিয়মিত দৌঁড়ালে, সাঁতার কাটলে, সাইক্লিং করলে এবং প্রকৃতির সান্নিধ্যে খানিকক্ষণ হেঁটে বেড়ালে সেরাটনিন বৃদ্ধি পায়।
- ডার্ক চকলেট খেলে, হাস্যরসাত্মক কোন নাটক বা সিনেমা দেখলে, নিয়মিত ব্যায়াম করলে এন্ডোরফিন বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।
৩. মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় চা
মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ভেষজ চা দারুন উপকারী। যেমন: ক্যামোমিল চা দুঃশ্চিন্তা, ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি দেয় এবং ঘুমাতে সাহায্য করে। ল্যাভেন্ডার চা স্নায়ুকে শান্ত করে।
আবার জাফরান চা শরীরে সেরাটোনিনের পরিমাণ বাড়ায় যা চিত্তে সুখময় অনুভূতির জোগান দেয়। সর্বশেষে আসে সবুজ চা যা মন এবং স্মৃতিশক্তি ভালো রাখে।
৪. মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় জার্নালিং পদ্ধতি
উদ্ভুত পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিয়ে তুলনামূলকভাবে ভালো থাকার উপায় হলো নিজের মনে চলতে থাকা সমস্ত অনুভূতিকে ও অস্থিরতাকে ভেতর থেকে বের করে দেয়া, সোজা কথায় মনের ভার লাঘব করা। কিন্তু আপনি মনের কথাগুলি কাউকে বলতে চান না, তখন কী করবেন?
একটা ডায়রি বা খাতায় নিয়মিত আপনার মনের কথা লিখতে পারেন।
আবার ধরুন, আপনি জানেন না কোথায় শুরু করবেন, তারও উপায় রয়েছে।
গুগলে ইংরেজিতে মেন্টাল হেলথ জার্নাল প্রম্পট লিখে খোঁজ করুন। সেখানে জার্নালিং করার জন্য পাঁচটা অথবা দশটার মতো কিছু প্রশ্ন থাকে।
এই ছোট ছোট প্রশ্নের উত্তর লিখতে থাকুন, নিজের মতো করে। কয়েকদিন পর দেখবেন আপনি নিজেই নিজের অনুভূতিগুলো লিপিবদ্ধ করতে পারছেন। উদাহরন হিসেবে কিছু প্রশ্ন উপস্থাপন করছি:
- আজকের দিনটা কেমন গেল?
- জীবনের উদ্দ্যেশ্য কী?
- সব থেকে আনন্দময় তিনটি মুহূর্ত
- আজকে করা তিনটি ভালো কাজ
- আপনার জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কে?
- প্রিয়জনকে একটি চিঠি লিখুন।
৫. বই পড়ুন
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কম সময় দিয়ে এই বাড়তি সময়টুকু বই পড়ে কাজে লাগাতে পারেন। হয়তো বা ছাত্রজীবনে বই পড়ার অভ্যাস ছিল কিন্তু চাকরি বা সংসারজীবনে প্রবেশের পর ব্যস্ততায় সেই অভ্যাস আর ধরে রাখতে পারেননি।
এখনই সময় পুরনো অভ্যাস ঝালাই করার। নিজের রুচিমতো হালকা কোনো বই দিয়ে শুরু করতে পারেন।
শেষ কথা
সবশেষে বলি, নিজের যত্ন নিন। যদি মানসিক চাপের মধ্যে আমরা দিনের পর দিন অতিবাহিত করতে থাকি, তাহলে মানসিক স্বাস্থ্য এর পাশাপাশি শারীরিকভাবেও মারাত্নক সমস্যা তৈরি হতে পারে।
মানসিকভাবে বিপর্যস্ততা সবার জীবনেই আসে এবং সামনেও আসতে পারে, কিন্তু সামনে এগিয়ে যাওয়ার নামই জীবন, থেমে থাকা মৃত্যুর সমান।
আমরা প্রত্যেকেই আমাদের আপনজনদের ভালো-মন্দের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে চলি। সুতরাং, আমাদের ভালো থাকাটা খুবই প্রয়োজন।
আপনার জীবনেও কি এমন মানসিক স্বাস্থ্য জনিত সমস্যা হয়েছিল? কিভাবে কাটিয়ে উঠেছিলেন তা কমেন্ট করে আমাদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেনা যেন।