রক্তদান ও বাংলাদেশে রক্তদানের অবস্থা

বাংলাদেশে রক্তদানের অবস্থা

বর্তমানে রক্তদান কথাটা শুনলেই আমাদের সামনে একটি সহজ চিত্র ভেসে ওঠে, হাসপাতাল রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রের বেডে এক পূর্ন বয়স্ক সুস্থ ব্যক্তির হাত। বিনামূল্যে রক্তদানের মাধ্যমে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন সম্ভব। হতে রক্ত একটি প্লাস্টিকের নলের মাধম্যে এসে একটি ব্যাগে জমা হওয়া। রক্তদান বিষয়টি ঠিক এমনটাই, পূর্ন বয়স্ক কোন সুষ্ঠ ব্যক্তির স্বেচ্ছায় বিনামূল্যে রক্ত দেওয়ার প্রক্রিয়া। ব্যক্তি স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে রক্তদান করে এজন্য একে স্বেচ্ছায় রক্তদানও বলা হয়। বিশুদ্ধ রক্ত পরিসঞ্চালনের মূল ভিত্তি হলো স্বেচ্ছায় রক্তদান করা।

১৪ জুন বিশ্ব রক্তদাতা দিবসে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রতি বছর দিবসটি পালন করা হয়। স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে রক্তদান করে যারা প্রতি বছর কোটি কোটি মানুষের প্রাণ বাঁচাচ্ছেন, পর্দার আড়ালে থাকা সেই সকল মানুষ সহ সকলকে স্বেচ্ছায় রক্তদানে উৎসাহিত করাই এই দিবসের উদ্দেশ্য। বাংলাদেশ কি বিশ্ব রক্তদাতা দিবসের এই উদ্দেশ্য পূরণে সক্ষম হচ্ছে?

বাংলাদেশে রক্তের চাহিদা ও স্বেচ্ছায় রক্তদানের অবস্থা

বাংলাদেশে প্রতি বছর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সাথে বাড়ছে বিশুদ্ধ রক্তের চাহিদাও। জানুয়ারি ২০২০ এ সময় টিভির একটি অনলাইন প্রতিবেদন অনুসারে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে সর্বমোট প্রায় ১৩ লাখ ব্যাগ বিশুদ্ধ রক্তের চাহিদা ছিল। এই চাহিদার বিপরীতে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মিলে প্রায় ১০.৫ লাখ ব্যাগ রক্ত সরবরাহ করতে সক্ষম হয়। সরবরাহকৃত এই রক্তের বেশির ভাগ ছিল রিলেটিভ ডোনার, ৩০-৩৫ শতাংশ ছিল বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হতে। তবে বিশাল একটা এমাউন্ট (প্রায় ১০-১৫%) এসেছে নেশাখোর রক্ত বিক্রেতাদের থেকে। যাদের রক্ত শরীরে নিলে এইচআইভি সহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

সুতরাং দেশে প্রতি বছর প্রায় দেড় লাখ ব্যাগ বিশুদ্ধ  রক্তের ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে প্রতিবছর বাড়ছে বিশুদ্ধ রক্তের চাহিদা। কিন্তু সেই তুলনায় বাড়ছে না স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংখ্যা। ইউএন পপুলেশন প্রজেকশন ২০১৫ এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ যুবক অর্থাৎ প্রায় ৪৭.৬ মিলিয়ন। এ সংখ্যা প্রতি বছর প্রায় ১০-১২ লাখ করে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আরো পড়ুন:  রক্তদানের পূর্বে যে গুরুত্বপূর্ন বিষয়গুলো জানতে হবে

বাংলাদেশে মোট যুবকের দুই শতাংশও যদি বছরে একবার স্বেচ্ছায় রক্তদান করে তবে বাংলাদেশ প্রতিবছর তার বিশুদ্ধ রক্তের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হবে। একবার রক্ত দিয়েছেন এমন রক্তদাতার সংখ্যা বেশি হলেও বহুবার রক্ত দিয়েছেন এমন রক্তদাতার সংখ্যা বাংলাদেশে খুবই কম। উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় প্রতি হাজারে প্রায় ৪৩ জন স্বেচ্ছায় রক্তদাতা। কিন্তু বাংলাদেশে এ সংখ্যা প্রতি হাজারে মাত্র তিন জন।

স্বেচ্ছায় রক্তদানে বিগত বিশ বছরে বাংলাদেশে কিছুটা অগ্রগতির পেছেন রয়েছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতা সংগঠন গুলোর নিরলস পরিশ্রম। সমগ্র দেশ ব্যাপী স্বেচ্ছায় রক্তদান ও স্বেচ্ছায় রক্তদানে উৎসাহিত করে যাচ্ছে বাঁধন, সন্ধানী, মেডিসিন ক্লাব এর মতো স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংগঠন গুলো। এছাড়াও আঞ্চলিক স্বেচ্ছায় রক্তদাতা সংগঠন গুলোও নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে।

আমাদের সমাজের বেশির ভাগ মানুষ রক্তদানের উপকারিতা, রক্ত দেওয়ার পূর্বে কি কি বিষয় জানতে হবে কিংবা একজন মানুষ কোন কোন অবস্থায় রক্ত দিতে পারবে না সেসম্পর্কে জানিনা। অনেকের মধ্যে ভুল ধারণা রয়েছে যে, আমি না দিলে কি হবে, আরো কোটি কোটি লোক আছে। আবার অনেকে মনে করেন বি পজেটিভ, ও পজেটিভ তো সব প্রচুর রয়েছে, আমি না দিলেও পেয়ে যাবে। কিন্তু আপনি একটু এভাবে চিন্তা করে দেখুন, বি পজেটিভ রক্ত যেমন প্রচুর রয়েছে, তেমনি প্রতিদিন বি পজেটিভ এর চাহিদাও বেশি, তাই আপনাকে যখন বলা  হয়েছে তখন আপনিই তাদের শেষ আশা ভরসা। বি নেগেটিভ, এবি নেগেটিভ রক্ত পাওয়া যায়না,কোন মেডিকেলেও এমন রেয়ার রক্তের প্রয়োজন মাসে একবার দইবারের বেশি হয়না। তাই এখন থেকে এই ভুল ধারণা নিয়ে রক্তদান থেকে বিরত থাকার চেষটা করবেন না।

রক্তদানে বাংলাদেশের যুবকদের মনে মোটা সূঁচের ভয় প্রধান বাধা হিসেবে কাজ করে। ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১ সালের এই রক্তঝরা জাতির কাছে মোটা সূঁচের এই অযৌক্তিক ভয় মোটেই কাম্য নয়। তাই আমাদের প্রত্যেক সুস্থ্য ও রক্তদানে সক্ষম ব্যক্তির উচিত স্বেচ্ছায় বিনামূল্যে রক্তদান করা এবং অন্যকে স্বেচ্ছায় রক্তদানে উৎসাহিত করা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top