ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির উপায় : ডিপ্রেশন খুবই কম এবং গুরুতর রোগ যা আপনার অনুভব, আপনার চিন্তাভাবনা এবং আপনার কাজকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। ডিপ্রেশন শব্দটি ছোট হলেও এর ওজন একটু বেশীই।
২০১৭ সালের একটি পরিসংখ্যানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডিপ্রেশন নিয়ে একটি প্রতিবেদন পেশ করে। প্রতিবেদনটিতে দেখা যায় পৃথিবীতে মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০.০৭% মানুষ মানসিক অসুস্থতায় ভুগছে, সংখ্যাটা ছিলো ৭৯২ মিলিয়ন।
মানসিক অসুস্থতা গুলোর মধ্যে প্রথম হয়েছিলো “দুশ্চিন্তা” এবং দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলো “ডিপ্রেশন”, ২৬৪ মিলিয়ন মানুষ ডিপ্রেশনে ভুগছিলো।
ডিপ্রেশনের সূচনাটা ঘটে দুশ্চিন্তা থেকে। আমরা কি কখনও ভাবতে পারি যে এই ডিপ্রেশন কতটা ভয়াবহ হলে একজন মানুষ নিজেকে মৃত্যুর দিকেও ঠেলে দেয়?
ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পাওয়ার সঠিক উপায় খুঁজে পেতে হলে আমাদের আগে ডিপ্রেশনের সাথে পরিচিত হতে হবে। আর্টিকেলটিতে আমরা ডিপ্রেশন কি, ডিপ্রেশনের কারণ, লক্ষণ ও ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির উপায় জেনে নিবো, ইন-শা’আল্লাহ।
একনজরে সম্পূর্ণ আর্টিকেল
ডিপ্রেশন কি | What is Depression in Bangla?
ডিপ্রেশন এক ধরনের মানসিক রোগ বা মনের রোগ যার সৃষ্টি অনেক মাধ্যমেই হতে পারে। হতে পারে মন খারাপের জন্য, হতে পারে অবসাদের জন্য (চিকিৎসা শাস্ত্রে ফ্যাটিগ নামে পরিচিত), হতে পারে দুশ্চিন্তার জন্য। নানা কারণেই হতে পারে। তবে, ডিপ্রেশন বলতে মূলত অবসাদের তীব্র মাত্রাকেই বুঝায়।
যে যেভাবেই বলি না কেনো, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ডিপ্রেশনকে অন্যভাবে চিহ্নিত করেছে। WHO এর মতে ডিপ্রেশন হলো শক্তিহীনতা এবং উৎসাহহীনতা। তবে সবচেয়ে ভালো সংজ্ঞা দিয়েছেন মনোবিজ্ঞানী অ্যারন বেক। তার ভাষ্যমতে,
নিজের, পরিবেশের এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার সম্মিলিত প্রকাশই হলো ডিপ্রেশন।
ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির উপায় জানার আগে আমাদের ডিপ্রেশনের পিছনের কারণ খুঁজে বের করা জরুরী, তাই চলুন কারণগুলো বিশ্লেষন করে দেখি।
ডিপ্রেশন এ কারণ কি?
ডিপ্রেশনের নির্দিষ্ট কোন কারণ জানা না গেলেও এই রোগ সৃষ্টির সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কারণ সম্পর্কে জানা গেছে। নিম্নে আমরা সেসব কারণ সম্পর্কেই জানবো;
- জেনেটিক কারণ: পরিবারের ঘনিষ্ঠ আত্নীয় স্বজনের মধ্যে ডিপ্রেশন সমস্যা থাকলে এ সমস্যা হতে পারে।
- বায়োকেমিক্যাল কারণ: মস্তিস্কের সেরাটোনিন (নানা অনুভূতি জোগানকারী) ও নরএড্রানালিন এর ঘাটতি এবং অনিয়ন্ত্রিত কর্টিসল হরমোন বৃদ্ধিকে ডিপ্রেশন সৃষ্টির রাসায়নিক ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়।
- ব্যক্তিত্ব: উদাসী, দুশ্চিন্তাগ্রস্থ ব্যক্তি, ছোট কিছুকে বড় করে দেখা, নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়া-এসব সমস্যাও ডিপ্রেশন বাড়িয়ে দেয়।
- আদর ও অবহেলা: যে সব শিশু মা-বাবার স্নেহ বঞ্চিত, পারিবারিক ঝগড়ার মধ্যে বেড়ে ওঠে, ভুল প্যারেন্টিং এর কারণে তাদের মধ্যে ডিপ্রেশনের মাত্রা বেশি থাকে। এই কারনটি একসময় মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়।
- রোগব্যাধি ও ঔষুধ: স্নায়ুবিক ও হরমোনের রোগের জন্য কিছু ঔষুধ যেমন, জন্মনিরোধক পিল, স্টেরয়েড মস্তিস্ককে প্রভাবিত করে ডিপ্রেশন বাড়াতে পারে। এই ধরনের ঔষুধ নিয়মিত সেবন করলে যেকেউ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যেতে পারে।
- অন্যান্য কারণ: গর্ভাবস্থায় ও অনেক দিন যাবৎ নিদ্রাহীনতাও ডিপ্রেশন বাড়াতে পারে। আবার পারিবারিক বন্ধন, বৈবাহিক জীবনে অসুখী, কর্মস্থলের সমস্যা, একাকীত্ব ইত্যাদি সমস্যার জন্যও ডিপ্রেশন হয়ে থাকে। প্রেমে ব্যর্থতা, দারিদ্রতা, অসামাজিক পরিবেশের কারণেও ডিপ্রেশন হয়ে থাকে। বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে প্রেম ও পড়াশোনায় ব্যর্থতায় ডিপ্রেশনে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
ডিপ্রেশন এর লক্ষণ
- কোনকিছুতে মনোনিবেশ করতে না পারা, প্রায়ই কোন বিষয়ে ভুলে যাওয়া (ডিমেনসিয়া রোগ) এবং সিদ্ধান্ত নিতে না পারার মতো সমস্যা।
- বেপরোয়া আচরণ, জিনিসপত্র ভাঙ্গা, বেপরোয়া গাড়ি চালানো বা বিপজ্জনক খেলাধুলায় হঠাৎ আগ্রহী হওয়া।
- প্রতিদিনের কাজকর্মের প্রতি আগ্রহ হারানো।
- আগের শখ, বিনোদন, সামাজিক ক্রিয়াকলাপ নিয়ে হঠাৎই আগ্রহ হারিয়ে ফেলা।
- ক্লান্তি, অসহায়ত্ব ও হতাশার সৃষ্টি হওয়া। আমার কিছুই কখনও উন্নত হবে না এবং আমার পরিস্থিতি উন্নত করতে আমি কিছুই করতে পারবোনা – এমন নির্মম দৃষ্টিভঙ্গি।
- হঠাৎই উত্তেজিত, অস্থির বা হিংস্রতা বোধ করা।
- ধৈর্য্য-সহনশীলতার মাত্রা কমে যাওয়া, বিনা কারণে মেজাজ হারানোর মতো সমস্যা দেখা দেয়।
- অপরাধবোধ, অযোগ্যতা এবং অসহায়ত্বের অনুভূতির সৃষ্টি হওয়া।
- অনিয়মিত ঘুম, অনিদ্রা, খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠা বা খুব বেশি ঘুমানো।
- যৌনতাসহ আনন্দদায়ক জিনিসগুলির প্রতি অনাগ্রহের সৃষ্টি।
- অত্যাধিক ক্ষুধা হ্রাস।
- জ্বালা ও অস্থিরতা, প্রায়শই শরীর এবং মাথাব্যথায় আক্রান্ত হওয়া।
- এমন হজম সমস্যা যা চিকিৎসা করেও ঠিক হচ্ছে না।
- ক্রমাগত বিষন্ন, উদ্বিগ্ন বা “শূন্য” অনুভূতির সৃষ্টি।
- আত্মঘাতী চিন্তা এবং প্রচেষ্টা।
আমরা এতক্ষন পর্যন্ত উপরের আলোচনায় depression কি, ডিপ্রেশন কেন হয় এবং ডিপ্রেশন এর লক্ষণ সম্পর্কে জেনেছি। তবে আশার কথা হলো ডিপ্রেশ্ন পার্মানেন্ট কোন সমস্যা নয়, ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির উপায় রয়েছে। নিজের চেষ্টা এবং আশে পাশের মানুষের সামান্য সহানুভূতিই এজন্য যথেষ্ট হতে পারে।
আসুন depression theke muktir upay সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করা যাক।
ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায়
১। নিজের ডিপ্রেশনের কারণ খুঁজে বের করুন
ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির উপায় আপনার কাছেই রয়েছে। কারণ আপনার চেয়ে আপনাকে এই পৃথিবীতে আর কে এতটা ভালভাবে জানে?
আপনার ডিপ্রেশনের লক্ষণগুলো অন্য কোনো শারিরীক অবস্থার (রোগ) কারণে কিনা তা নির্ধারণ করা গুরুত্বপূর্ণ। যদি তাই হয় তবে ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পেতে প্রথমেই চিকিৎসা করা দরকার।
আপনার হতাশার তীব্রতাও একটি কারণ। যত তীব্র হতাশা, তত বেশি নিবিড় চিকিৎসা আপনার প্রয়োজন হতে পারে।
২। পারিবারিক-সামাজিক সাপোর্ট নিন
যত বেশি সামাজিক সংযোগ গড়ে তুলবেন ততই হতাশার হাত থেকে রক্ষা পাবেন। পরিবারের সদস্য বা বিশ্বাসযোগ্য বন্ধু-বান্ধবদের সাথে কোন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে দ্বিধা করবেন না। সাহায্য প্রার্থনা করা দুর্বলতার লক্ষণ নয় এবং এর অর্থ এই নয় যে আপনি অন্যের বোঝা হয়ে যাচ্ছেন।
৩। ডিপ্রেশন থেকে বের হতে এক্সারসাইজ করুন
নিয়মিত শারীরিক অনুশীলন শুধু শক্তি বৃদ্ধি করে না, হতাশা নিরাময়েও ঔষুধের মতো কাজ করে। যোগব্যায়াম কেবল সেরোটোনিন, এন্ড্রোফিনস এবং অন্যান্য মস্তিষ্কের রাসায়নিক উপাদানকেই বাড়ায় না, এটি মস্তিষ্কের নতুন কোষ এবং কানেকশনের বিকাশ ঘটায়।
এজন্য আপনার ম্যারথনের প্রশিক্ষণ নিতে হবে না, এমনকি প্রতিদিন আধা ঘন্টা হাঁটাও একটি বড় পার্থক্য তৈরি করতে পারে। তবে ভাল ফলাফলের জন্য প্রতিদিন ৩০ থেকে ৬০ মিনিট শারিরীক ব্যায়াম করতে পারেন।
৪। স্ট্রেস কমিয়ে ফেলুন
স্ট্রেস কমাতে জীবনে পরিবর্তন আনুন। অতিরিক্ত স্ট্রেস মানসিক চাপকে বাড়িয়ে তোলে এবং ডিপ্রেশনের ঝুঁকি বাড়ায়।
কোন বিষয়গুলো আপনার জন্য চাপ হয়ে যাচ্ছে তা খুঁজে বের করুন যেমন- অধিক কাজের প্রেশার কিংবা অসুস্থ সম্পর্ক। এসব চাপ কমানোর চেষ্টা করুন এবং সম্ভব হলে মুক্তির উপায় খুঁজে বের করুন।
৫। নিয়মিত পর্যাপ্ত ঘুম
ঘুম আমাদের মেজাজ নিয়ন্ত্রণে শক্তিশালী ভূমিকা রাখে। আপনার যখন পর্যাপ্ত ঘুম না হয় তখন হতাশার লক্ষণগুলি আরও প্রকট ভাবে দেখা দেয়। অপর্যাপ্ত ঘুম বিরক্তি, মেজাজ এবং ক্লান্তি বাড়িয়ে তোলে।
যদি সত্যিই ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে থাকেন কিংবা বের হওয়ার ইচ্ছা থাকে তবে, প্রথমে আপনি প্রতি রাতে পর্যাপ্ত ঘুম পাচ্ছেন তা নিশ্চিত করুন, প্রতি রাতে সাত থেকে নয় ঘন্টা ঘুমানোর চেষ্টা করুন।
ডিপ্রেশন দূর করার করার আরো কিছু উপায়:
- লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন সব সময় যেন নৈতিকতার মাধ্যমে আনন্দে থাকা যায় ও উপভোগ করা যায়।
- সুখ-দুঃখকে গ্রহন করতে হবে। নিজের ভালো থাকার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে।
- সবসময় পজিটিভ থকতে হবে। যে কোনো কাজ আপনি পারবেন এমন মানসিকতা থাকতে হবে।
- নিজের ভুলগুলোকে বড় করে না দেখে শুধরে নিয়ে নিজেকে সুযোগ দিতে হবে।
- ধর্মীয় কাজগুলোতে নিজেকে ভালোভাবে যুক্ত করতে হবে।
- কেউ আপনাকে কষ্ট দিতে চাইলে এড়িয়ে চলুন। মোট কথা ঐ ব্যক্তিকে ইগনোর করুন যে আপনাকে কষ্ট দিতে চায়।
- পুষ্টিকর খাবার গ্রহন করুন।
- সারাদিনের একটি রুটিন করুন এবং তা মেনে চলার চেষ্টা করুন।
- প্রয়োজনে সাইক্যাট্রিস্ট কিংবা সাইকোলজিস্টের সাথে কথা বলুন।
ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে শেষ কথা
ডিপ্রেশন কি? বুঝতে পেরেছেন তো! আমাদের কারো জীবনই স্থিতিশীল নয়, সুখ-দুঃখ নিয়েই মানুষের জীবন। কষ্ট, দুর্দশা, ডিপ্রেশন না থাকলে সুখের কি গুরুত্ব থাকতো? ডিপ্রেশন যদি এসেই যায় তবে নিজে ভেঙ্গে না পরে ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন।
বিখ্যাত ইংলিশ রাইটার ও অভিনেতা ম্যাট লুইসের একটি কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।
“Keep yourself busy if you want to avoid depression. For me, inactivity is the enemy.” — Matt Lucas
ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পেতে নিজেকে ব্যস্ত রাখা খুবই ইফেক্টিভ উপায়। তাই, এমন কোনো কঠিন অবস্থায় পড়ে গেলে নিজেকে একা, অলস, কর্মহীন থাকার সুযোগ দিবেন না।
ডিপ্রেশনে আক্রান্ত মানুষ প্রায়শই আত্মঘাতী হয়ে থাকেন, কিন্তু আত্মহত্যার পরিণাম কি বলুন তো! আপনি যদি দুনিয়ায় নিজেকে একজন ব্যর্থ হিসেবে মেনেও নেন, তাহলে কেনো আখিরাতকেও নষ্ট করতে চাচ্ছেন! দুনিয়াই তো শেষ কথা নয় (ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জন্য)।
নিজেকে উজার করে দিন, নিজের মনের বিরূদ্ধে কিছু না করে আত্মপত্যয়ী থাকুন এবং ডিপ্রেশন মুক্ত থাকুন। মনে রাখবেন বর্তমান অবস্থাই আপনার চিরস্থায়ী অবস্থা নয়।
প্রচন্ড ডিপ্রেশনে ভুগছে এমন কেউ যদি আপনার আশে পাশে থাকে তবে ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির উপায় দেখান, তার পাশে থাকুন এবং আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে সাহায্য করুন।
Thanks a lot
অসাধারণ ❤️
ধন্যবাদ