হাই প্রেসার যার আরেক নাম উচ্চ রক্তচাপ হলো এমন একটি রোগ যার কারণে কোন ব্যক্তির রক্তের চাপ সব সময়েই স্বাভাবিকের চেয়ে ঊর্ধ্বে থাকে। রক্তচাপ হার্ট পাম্পিং ও ধমনীতে রক্ত প্রবাহের প্রতিরোধ, উভয় পরিমাণের দ্বারাই নির্ধারিত হয়। হৃদপিন্ড যত বেশি রক্ত পাম্প করবে এবং ধমনী যত সরু হবে, রক্তচাপ তত বেশি হবে। উচ্চ রক্তচাপ শরীরের বিভিন্ন সমস্যা তৈরি করতে পারে, তারমধ্যে হৃদরোগের সমস্যা প্রধান। তবে, উচ্চ রক্তচাপ কমানোর প্রাকৃতিক উপায় রয়েছে। কিছু নিয়ম মেনে চললে হাই প্রেসার কমানো যায়।
উচ্চ রক্তচাপ বা হাই প্রেসার (High Blood Pressure) সারাবিশ্বে এক আতংকের নাম। হাই প্রেসারের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করতে সঠিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক। তাই আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় উচ্চ রক্তচাপ কি?, উচ্চ রক্তচাপ কমানোর প্রাকৃতিক উপায় নিয়ে।
‘বাংলাদেশ জনমিতি স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৭-১৮’-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতি চার জনের একজন উচ্চ রক্তচাপ জনিত সমস্যায় ভুগে থাকেন। (তথ্যসূত্র – বিবিসি)
অর্থাৎ, প্রাপ্তবয়স্কদের মাঝে বাংলাদেশের প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষের উচ্চ রক্তচাপ সমস্যা রয়েছে। সারাবিশ্বে অধিকাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের উচ্চ রক্তচাপ সমস্যা রয়েছে, সংখ্যায় বললে যা প্রায় ১৫০ কোটি।
উচ্চ রক্তচাপ জনিত সমস্যার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আগে থেকে কোন উপসর্গ বোঝা যায় না। এজন্য উচ্চ রক্তচাপকে নীরব ঘাতক বলা হয়। এটি হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, হৃদরোগ এমনকি মৃত্যুরও কারণ হতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে বিশ্বব্যাপী ১৭ ই-অক্টোবর ‘বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস’ (ওয়ার্ল্ড হাইপারটেনশন ডে) পালন করা হয়।
তাই সুস্থ থাকতে উচ্চ রক্তচাপ কী এবং হাই ব্লাড পেসার কেন হয়? এবং উচ্চ রক্তচাপ কমানোর প্রাকৃতিক উপায় জানতে হবে।
একনজরে সম্পূর্ণ আর্টিকেল
উচ্চ রক্তচাপ কি?
উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপেরটেনশন (hypertension) হলো মানব দেহের ধমনি গাত্রের এমন এক অবস্থা যখন স্বাভাবিকের তুলনায় মানষের ধমনি গাত্রের চাপ বেশি থাকে।
আমরা জানি যে, আমাদের হৃদপিন্ড প্রতিনিয়ত ফুসফুস থেকে অক্সিজেন যুক্ত রক্ত সারাদেহে পাম্প করে। আর এই রক্ত পরিবহনের কাজ করে ধমনি। যার দরুণ আমাদের ধমনিতে এক ধরনের চাপ অনুভূত হয়। একেই রক্তচাপ বা নাড়ি চাপ বলা হয়।
মানবদেহে এ রক্তচাপের স্বাভাবিক সর্বনিম্ন মান ৮০, যাকে ডায়াস্টোলিক বলে। অন্যদিকে সর্বোচ্চ স্বাভাবিক রক্তচাপ ১২০, যাকে সিস্টোলিক চাপ বলা হয়। কারো রক্তচাপ এই সিস্টোলিক চাপের উপরে থাকলে তাকে উচ্চ রক্তচাপ বলা হয়। যা পরবর্তীতে ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপ এর কারণ কি?
বয়স বাড়ার সাথে সাথে উচ্চ রক্তচাপ বাড়তে থাকে। তবে অনেক ক্ষেত্রে তরুনদেরও উচ্চ রক্তচাপ সমস্যা দেখা যায়। কিন্তু উচ্চ রক্তচাপের পিছনে কারণ কি? চলুন জেনে নেওয়া যাক।
হাই পেসার কে আমরা দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভাগে ভাগ আমরা করতে পারি। একটা হচ্ছে এসেন্সিয়াল বা আবশ্যকীয় উচ্চ রক্তচাপ। যা সাধারণত বয়স বাড়ার সাথে সাথে হয়ে থাকে।
আর অন্য টি হচ্ছে ৩০ বা তার কম বয়সের তরূণদের যখন হয়। এটি নিয়ে আমাদের বিশেষ চিন্তা করতে হবে! হয়তো এর পিছনে কোন কারণ আছে! থাকতেই পারে। যদিও এখনো উচ্চরক্ত চাপের সঠিক কোনো কারণ জানা যায়নি। তবে বিশেষজ্ঞগণ কিছু ধারণা দিয়েছেন যেগুলোর কারণে হয়তো হাইপারটেনশন সমস্যা হতে পারে।
অনেকের কিডনি বা বৃক্কে (প্রস্রাব তৈরি করার যন্ত্র) যদি কোনো সমস্যা তৈরি হয়, তাহলে ব্লাড প্রেশার বাড়তে পারে। আবার হার্টের ভেতরে মহাধমনি যেটি, সেখানে যদি কোনো অস্বাভাবিকতা থাকে, সেটার জন্যও হতে পারে।
আবার ফিউকোমা সাইটোমা নামের মানব দেহে এক টিউমার আছে। সেখান থেকে এক ধরনের হরমোন নির্গত হয়। তার প্রভাবেও হাই ব্লাড প্লেসার বা উচ্চ রক্ত চাপ হতে পারে। স্টেয়রেড জাতীয় ওষধ খেলেও হতে পারে।
কিংবা ওজন কমানোর জন্য যে ওষুধ সেবন করা হয়, তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফলেও উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা হতে পারে।
থাইরয়েডের এক ধরনের হরমোন যদি আলাদাভাবে নেওয়া হয়। অথবা থাইরয়েডের কোনো সমস্যা হয় বা হাইপার থাইরয়েডিজম হয়, তাহলেও হাইপারটেনশন হতে পারে। মস্তিষ্কের ভেতরে একটি বিশেষায়িত টিউমারের মতো রয়েছে। তখনো প্রেশার বেড়ে যেতে পারে। আর এ ছাড়া জীবনযাপনের ধরন ও খাদ্যাভ্যাস রয়েছে।
রক্তচাপ কত প্রকার?
একজন পূর্ণবয়ষ্ক মানুষের রক্তচাপের শ্রেণিবিন্যাস :
শ্রেণি |
সিসটোলিক (মি.মি পারদ) | ভায়াস্টোলিক |
নিম্ন রক্তচাপ |
<৯০ মি. মি পারদ চাপ |
<৬০ মি.মি পারদ চাপ |
স্বাভাবিক রক্তচাপ |
৯০-১১৯ মি. মি পারদ চাপ |
৬০-৭৯ মি. মি পারদ চাপ |
স্বাভাবিক কিন্তু উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে |
১২০-১৩৯ মি. মি পারদ চাপ |
৮০-৮৯ মি. মি পারদ চাপ |
উচ্চ রক্তচাপ গ্রেড-১ |
১৪০-১৫৯ মি. মি পারদ চাপ |
৯০-৯৯ মি. মি পারদ চাপ |
উচ্চ রক্তচাপ গ্রেড-২ |
১৬০-১৭৯ মি. মি পারদ চাপ |
১০০-১১৯ মি. মি পারদ চাপ |
উচ্চ রক্তচাপ সম্পর্কিত জরুরি অবস্থা |
১৮০ মি. মি পারদ চাপ |
১১০ মি. মি পারদ চাপ |
উচ্চ রক্তচাপ কমানোর প্রাকৃতিক উপায়
হেলথি লাইফস্টাইল বা স্বাস্থ্যবান্ধব জীবনযাত্রার মাধ্যমে কীভাবে রক্তচাপ কমিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, আসুন এবার সেবিষয়ে জেনে নেওয়া যাক।
১. সোডিয়াম নিয়ন্ত্রণ
আমাদের গ্রহণযোগ্য খাদ্য লবণের প্রধান উপাদান হচ্ছে সোডিয়াম। এ সোডিয়াম আমাদের শরীরে গিয়ে পানি জমা করে রাখাতে পারে। যা পরবর্তীতে উচ্চ রক্তচাপের কারণ হয়ে যায়।
তাই উচ্চ রক্তচাপ কমাতে হলে অতিরিক্ত কাচা লবণ খাওয়া উচিত নয়। খাবারের সাথে কাচা লবণ খাওয়ার অভ্যাস থাকলে তা বর্জন করা জরুরি। এছাড়াও ক্যানজাত স্যুপ বা অন্যান্য খাবারেও প্রচুর সোডিয়াম থাকে। এই ধরনের খাবার পরিহার করতে হবে।
২. স্ট্রেস বা চাপ নিয়ন্ত্রণ
মানসিক চাপ, ডিপ্রেশন বেড়ে গেলে রক্তচাপ হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে। অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস, যেমন মদ্যপান বা ধূমপান করা। খাওয়া দাওয়ায় অনিয়ম করা, রাত জাগা ইত্যাদির কারনে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আমাদের অবশ্যই এসকল অভ্যাস বর্জন করতে হবে। জীবনের সকল দুঃশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করতে হবে।
৩. ওজন নিয়ন্ত্রণ
অতিরিক্ত শারীরিক ওজন সকল ধরনের হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপ দুইটারই ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তবে ওজন হ্রাসের জন্য কোন ঔষুধ সেবন করা যাবে না। এতে হিতে-বিপরীত হবে।
ওজন নিয়ন্ত্রণে অবশ্যই খাদ্য তালিকায় চর্বিযুক্ত খাবার ও বাড়তি মিষ্টি জাতীয় খাবার কমাতে হবে। পাশাপাশি ফল, শাক-সবজি, আমিষ ও আঁশযুক্ত খাবার বাড়িয়ে শরীরের ওজন কমাতে হবে।
এমনকি সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে ১০ পাউন্ড বা সাড়ে চার কেজি ওজন কমাতে পারলেও হাই প্রেসার সুনিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব। তাই আজকে থেকেই চর্বি জাতীয় খারারকে না বলুন। সুস্থ সুন্দর জীবন গড়ুন।
৪. গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ
অনেক সময় মহিলাদের কারো কারো গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ভাগে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। একে মেডিক্যালের ভাষায় জেস্টেশনাল হাইপারটেনশন বলে।
এই অবস্থা থেকে প্রি-এক্লাম্পশিয়া হতে পারে। যার দরুন অনেক সময় গর্ভের শিশুর ক্ষতিও হতে পারে। এমনকি মায়ের কিডনি ও মস্তিষ্কে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে, যা অতন্তত্য ভয়াবহ। কাজেই গর্ভাবস্থায় নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করা খুবই জরুরি।
৫. উচ্চ রক্তচাপ উদ্রেককারী ওষুধ পরিহার
আমরা অনেক সময় কফ সিরাপ, ব্যথানাশক, স্টেরয়েড জাতীয় ওষধ সেবন করি। আবার অনেকে ডায়েট পিল, জন্মনিরোধক বড়ি ও বিষন্নতার ওষুধ সেবন করেন।
কিন্তু এগুলো খাওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা হতে পারে। কাজেই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এসব ঔষুধ সেবন করবেন না।
খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন
কথায় আছে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ব্যাক্তিকে দেখলে রোগ-বালাই ভয়ে পালায়। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়ার জন্য অবশ্যই আমাদের সুষম খাবার গ্রহণ করতে হবে।
এজন্য আমাদের খাদ্যাভাসে একটু পরিবর্তন করতে হবে। ফলমূল, সবজি, কম চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত খাবার, মাছ, পোল্ট্রিজাত খাবার, বাদাম ইত্যাদি প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় রাখুন। গরু বা খাসির মাংস, স্যাচুরেটেড ফ্যাট, মিষ্টি এসব কম খাবেন।
৬. ব্যায়াম
শরীর সুস্থ রাখতে নিয়মিত ব্যায়ামের কোন বিকল্প নাই। একজন পূর্ণ বয়ষ্ক লোকের প্রতি সপ্তাহে ১৫০ মিনিটের মতো মাঝারি মাপের ব্যায়াম করা জরুরি।
যে কোনো ধরনের শারীরিক পরিশ্রমের কাজের মাধ্যমেও ব্যায়াম হতে পারে যেমন- বাগান করা, সাইকেল চালানো, হাঁটা। অথবা অন্যান্য অ্যারোবিক এক্সারসাইজের মাধ্যমে করা যেতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপ কমানোর প্রাকৃতিক উপায় নিয়ে শেষ কথা
উচ্চ রক্তচাপ কমানোর তাৎক্ষনিক কোনো উপায় এপ্লাই করার জন্য রক্তচাপ বেশি কি না জানা জরুরী। কারণ রক্তচাপ কমে গেলেও শরীরের জন্য ভালো নয়।
যদি প্রশ্ন করা হয় উচ্চ রক্তচাপ নাকি নিম্ন রক্তচাপ কোনটা বেশি মারাত্নক? তাহলে উত্তর অবশ্যই লো ব্লাড প্রেসার (Low blood Pressure) বা নিম্ন রক্তচাপ।
তাই মাঝে মাঝে আপনার রক্তচাপ মেপে দেখা উচিৎ। যাতে করে আপনি বুঝতে পারবেন যে আপনার রক্তচাপের কী অবস্থা। এতে আপনার নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে একটা ধারনা আসবে। রক্তচাপ বৃদ্ধি কিংবা উচ্চ রক্তচাপ কমানোর প্রাকৃতিক উপায় অবলম্বন করতে পারবেন।
যারা ধূমপান করছেন বা অন্য উপায়ে তামাক সেবন করছেন, তাদের অবশ্যই সেটা পরিহার করতে হবে। মদ্যপান করলে এর মাত্রা কমিয়ে আনতে হবে, মদ্যপান পরিহার করতে হবে।
হাই প্রেসার কমানোর জন্য প্রয়োজনে আপনাকে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। পাশাপাশি জীবন যাত্রায় আপনাকে কিছু আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে।
আপনার সুস্থতা আপনার কাছেই। এখন আপনিই ভাবেন যেমন আছেন তেমন থেকে উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যায় জীবন ঝুকি নিবেন, নাকি নিজের জীবনে, খাদ্যভাসে পরিবর্তন এনে সুস্থ্য সুন্দর জীবন গড়বেন।
আমরা উচ্চ রক্তচাপ কী এবং উচ্চ রক্তচাপ কেন হয়? এবং উচ্চ রক্তচাপ কমানোর প্রাকৃতিক উপায় জেনেছি। নিজে সচেতন হন, অন্যকেও জানান। সুস্থ্য জীবনের জন্য আগ্রীম শুভ কামনা।