জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই যুগে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ( Artificial Intelligence বা AI ) হচ্ছে সবকিছুর প্রাণশক্তি। আপনার ই-মেইল লিস্টে প্রতিদিন যেসব প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় মেইল আসে, সেগুলো স্পাম বা ইম্পরট্যান্ট তা কিভাবে নিজে নিজেই বিন্যস্ত হয় তা ভেবে দেখেছেন কি?
আবার আমরা ইউটিউবে যদি নির্দিষ্ট কোনো ভিডিও লিখে সার্চ করি তাহলে খেয়াল করে দেখবেন যে ইউটিউব আমাদের একই ক্যাটাগরির আরও ভিডিও সাজেস্ট করছে৷ এগুলো সবই হয় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর কারণে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আধুনিকায়ন হয়েছে বিশ্ব৷ চব্বিশ ঘন্টা আমরা প্রযুক্তির ভেতর ডুবে থাকি৷ মানুষ তার মেধা ও জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে সফলতার শীর্ষে আরোহন করেছে। তারই ধারাবাহিকতার সর্বশেষ সংযোজন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স।
একনজরে সম্পূর্ণ আর্টিকেল
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কি?
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর অর্থ হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। সহজ কথায়, মানুষের মতো বুদ্ধি ও জ্ঞান যে উপায়ে যন্ত্রের মধ্যে প্রয়োগ করা হয় বা বাস্তবায়ন করা হয়, তাই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স।
এটিকে একধরনের সফটওয়্যার টেকনোলজি বলতে এমন এক যন্ত্র যা মানুষের মতো করে কার্য সম্পাদন করতে সক্ষম হয়। যেমন: বর্তমানে গুগল এসিস্ট্যান্ট কিংবা আইফোনের সিরি’র সুবিধা সম্পর্কে সবাই কম বেশি জানি।
মোবাইল হাতে না নিয়ে ভয়েস দিয়ে কমান্ড করেই এসব আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়ে বিভিন্ন কাজ করে নেওয়া যায়, যেমন অ্যাপ ওপেন করা, গান, ভিডিও চালু ও বন্ধ করা, কোনো নাম্বারে কল দেওয়া, এলার্ম সেট করা, ইত্যাদি।
শুরুতেই আমি ইউটিউবের কথা বললাম। যদি মনে করে থাকেন আপনি ইউটিউবকে নিয়ন্ত্রণ করছেন তাহলে সেটি ভুল ধারণা। ইউটিউব আমাদের সার্চ করা তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে এবং পরবর্তীতে একই ধরনের ভিডিও গুলো সামনে আনতে থাকে।
আমাদের বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন: ফেসবুক, টুইটার বা ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্ট আছে৷ এগুলোতেও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তি ব্যাবহার হচ্ছে।
লাইক, কমেন্ট বা শেয়ার করলেই এই প্রযুক্তি আমাদের টার্গেট করা ডেটাটাগুলো প্রদর্শন করতে থাকে। অচেনা কোনো স্থানে ভ্রমণ করার সময় স্মার্টফোনে ব্যাবহৃত ম্যাপ ব্যাবহার করে আমরা গন্তব্য স্থানে পৌছাই, যা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তির বদৌলতে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর ইতিহাস
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনী নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য দূর্বোধ্য কোড ব্যাবহার করতো। যার মাধ্যমে তাদের যুদ্ধের দিকনির্দেশনা দেওয়া হতো। এই কোডগুলো ভাঙানো ব্রিটেন ও অন্যান্য মিত্র দেশগুলোর জন্য জরুরি ছিলো। যা মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিলোনা।
তাই, ১৯৪০ সালে ব্রিটিশ গণিতবিদ অ্যালান টুরিং সর্বপ্রথম এই কোড ভাঙানোর জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন। টুরিং এবং গর্ডন ওয়েলচের যৌথ প্রচেষ্টায় তৈরি করেন “বোম্বে” নামক কোড ব্রেকিং মেশিন৷ আধুনিক আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যাত্রা মূলত এভাবেই শুরু হয়েছিলো।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর ব্যবহার
বর্তমানে AI প্রযুক্তির বহুল ব্যবহার লক্ষ্যনীয়, তন্মধ্যে
- ড্রাইভারবিহীন গাড়ি
- ড্রোন ডেলিভারী
- নিরাপত্তা সিস্টেম
- অনলাইন মিডিয়ায় ইউজার টেস্ট পর্যবেক্ষণ
- ব্যাংকিং ক্ষেত্র, ইত্যাদি।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন গাড়ি ও ড্রোন
![আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর ব্যবহার](https://www.pratiborton.com/wp-content/uploads/2021/06/আর্টিফিশিয়াল-ইন্টেলিজেন্স-এর-ব্যবহার.jpg)
চালকবিহীন গাড়ি যেখানে রূপকথার মতো ছিলো, তা বাস্তবে পরিণত করেছে Artificial Intelligence (AI). আমেরিকার গাড়ি নির্মান প্রতিষ্ঠান টেসলা এই কাজটি সফলভাবে করেছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে এই গাড়ি বুঝে যায় কখন রাস্তার লেন পরিবর্তন করতে হবে, কখন ব্রেক করতে হবে বা দূর্ঘটনা এড়াতে হবে। এছাড়া এই গাড়ি ম্যাপ ব্যাবহার করে যথাস্থানে যেতেও পারে। এই ধরনের গাড়ি আমেরিকাতে প্রায় পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি চলাচল করছে৷
অ্যামাজনের মতো প্রতিষ্ঠান ড্রোনের সাহায্যে অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের গ্রাহকের কাছে পণ্য পরিবহন করছে।
![AI প্রযুক্তি রোবট ডেলিভারী](https://www.pratiborton.com/wp-content/uploads/2021/06/AI-প্রযুক্তি-রোবট-ডেলিভারী.jpg)
মিউজিক বা মিডিয়ায়
নেটফ্লিক্স বা ইউটিউবে সার্চ দেওয়ার পর আমাদের জন্য সিদ্ধান্ত নেয় এআই প্রযুক্তি৷ কিভাবে হয় এসব?
আমরা যখন পছন্দের শিল্পীর গান লিখে সার্চ করি তখন একই ক্যাটাগরির আরও গান আমাদের সামনে চলে আসে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আমাদের সার্চের উপর ভিত্তি করে একই ধরনের রেজাল্ট দেখাতে থাকে।
তাছাড়া তুমুল জনপ্রিয় পাবজি, ফোর্টনাইট বা ফ্রি ফায়ারের মতো গেমগুলো এআই প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে সফল।
অনলাইন বিজ্ঞাপনে
এআই প্রযুক্তি ব্যাবহার করে অনলাইন বিজ্ঞাপন এখন রমরমা ব্যাবসা। এআই এ ক্ষেত্রে শুধু গ্রাহকের উপর নজরদারিই করেনা বরং চাহিদা ও পছন্দের উপর ভিত্তি করে তাদের সামনে বিজ্ঞাপন হাজির করে৷
এ কারণেই পুরো বিশ্বব্যাপী অনলাইন বিজ্ঞাপনের ব্যাবসা প্রায় পচিশ হাজার কোটি ডলার অতিক্রম করেছে।
ভ্রমণ বা লোকেশন
গুগলের সাহায্য নিয়ে আমরা নিমিষেই যেকোনো স্থানের ম্যাপ দেখে নিতে পারি। এটি পুরোটাই আসলে এআই নির্ভর। আবার ট্যাক্সিতে বা ব্যাক্তিগত গাড়িতে যে ম্যাপিং সিস্টেম থাকে তাও এআই নির্ভর।
বিমানে অটো পাইলট নামক একটি অপশন থাকে। কোনো কারণে পাইলট বিমান চালনায় অক্ষম হলে বা সমস্যায় পড়লে বিমানের অটো পাইলট সিস্টেম নিজে নিজেই অন হয়ে যায় এবং বিমান নির্দিষ্ট গতি ও উচ্চতায় আগের মতে চলতে থাকে। যা এআই প্রযুক্তিকে করেছে আরও সমৃদ্ধ।
ব্যাংকিং ক্ষেত্রে
ব্যাংকিং সেক্টরেও এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যাবহার করা হচ্ছে৷ খেয়াল করে দেখবেন আমরা যখন নতুন কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলি সাথে সাথেই আমাদের ফোনে এসএমএস চলে আসে এবং ই-মেইল আপডেট পাই।
ব্যাংকে লেনদেন করা, ব্যাংক গ্রাহকের তথ্য, নিরাপত্তা ও প্রতারণা রোধ করতে এআই কাজ করে চলেছে।
নিরাপত্তায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
নিরাপত্তা ও নজরদারিতে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স সবচেয়ে বেশি ব্যাবহৃত হচ্ছে৷ ড্রোন চালনা করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যাবহার করা হয়। নিজেদের নিরাপত্তার জন্য এবং শত্রুপক্ষের আক্রমণ থেকে বাচতে উন্নত দেশগুলো তাদের
গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে রাডার স্থাপন করে থাকে৷ এসব রাডার শত্রুর অবস্থান সম্পর্কে পূর্বেই সতর্ক করে থাকে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তির কারণেই এসব সম্ভব হচ্ছে। এছাড়া নিরাপত্তার কাজে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে
সিসি (ক্লোজ সার্কিট) ক্যামেরা লাগানো থাকে। এসব ক্যামেরা মানুষের চলাচল বিশ্লেষণ করে এবং আমরা নিরাপত্তা পাই।
পরিশেষ
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তির কারণে জীবনযাত্রার মান যেমন অনেক সহজ হয়েছে। তেমনি ধীরে-ধীরে অদক্ষ ও স্বল্পদক্ষ মানুষের চাকরি বা কর্মসংস্থান কমে যাবে। কারণ মেশিন বা রোবটের ব্যাবহার বেড়ে যাবে এবং অদক্ষ মানুষের চাহিদা কমে যাবে।
আবার উচ্চ দক্ষ মানুষদের জন্য সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান। সৃষ্টি হবে উন্নত প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিতে সুদক্ষ হয়ে গড়ে উঠার সুযোগ।
তাই, প্রযুক্তির সঠিক ব্যাবহারই হোক আমাদের কাম্য।