রোজার বৈজ্ঞানিক উপকারিতা ও শারীরিক সুস্থ্যতায় গুরুত্ব

রোজার বৈজ্ঞানিক উপকারিতা

রোজার বৈজ্ঞানিক উপকারিতা : আর কিছুদিন পরেই শুরু হয়ে যাবে সিয়াম সাধনার মাস রমজান। আসছে রোজা নিয়ে আমরা সবাই কমবেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ি ইফতার এবং সাহরির খাবারের মেন্যু তৈরির বিষয়ে। রোজার বৈজ্ঞানিক উপকারিতা ও গুরুত্ব আজ প্রমাণিত, অথচ আমরা বেশিরভাগ মানুষই এখনো রোজার উপকারিতা সম্পর্কে জানিনা।

রোজার বৈজ্ঞানিক উপকারিতা সম্পর্কে জানার পর ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বাইরেও অনেক লোক শারীরিক সুস্থ্যতার জন্য রোজা রাখছে। তাই, আজ আমরা কথা বলবো মনের ও শারিরীক সার্বিক সুস্থতায় রোজা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ সেই বিষয়ে। চলুন scientific benefits of ramadan fasting সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

একনজরে সম্পূর্ণ আর্টিকেল

রোজা (fasting in Islam) কি?

ইসলামিক দৃষ্টিকোণ মোতাবেক, রোজা বা সিয়াম হচ্ছে খাদ্য, পানীয়, ধূমপানসহ অন্যান্য কিছু বিধিনিষেধ থেকে নিজেকে সংযত রাখা অর্থাৎ সেগুলো এড়িয়ে চলা। মূলত নিজের মাঝে আত্মশুদ্ধি, আত্মসংযম এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণ গঠনের উদ্দেশ্যেই দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে কিছু নিষেধাজ্ঞা মেনে চলার একটি ভক্তিমূলক অনুশীলনই হচ্ছে রোজা।

রোজার বৈজ্ঞানিক উপকারিতা সমূহ

রোজা পালনের যে শুধু ধর্মীয় উদ্দেশ্যই আছে তা কিন্তু নয়। স্বাস্থ্যবিদ এবং গবেষকদের মতে, এর সাথে নিহিত আছে বেশকিছু বৈজ্ঞানিক উপকারিতা এবং স্বাস্থ্যগত কারণ ও উদ্দেশ্যও। চিকিৎসকদের মতে, দেহ, মন এবং মস্তিষ্কের জন্য রোজার মত স্বাস্থ্যকর এবং স্নায়বিক উপকারিতা সমৃদ্ধ শারীরিক অভ্যাস খুব কমই আছে।

আসুন শারীরিক সুস্থতায় রোজার বৈজ্ঞানিক উপকারিতা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

১। রোজা ডিটক্সিফিকেশন (detoxification) এ সাহায্য করে

দেহ থেকে বিষাক্ত পদার্থ দূর করে দেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গসমূহ পরিষ্কার এবং সচল রাখার প্রক্রিয়াই হলো ডিটক্সিফিকেশন। ডিটক্সিফিকেশন প্রক্রিয়ায় দেহকোষে জমে থাকা ফ্যাট বার্নের পাশাপাশি দেহের যাবতীয় টক্সিন অর্থাৎ বিষাক্ত পদার্থও ধ্বংস হয়ে যায়।

আরো পড়ুন:  রোজার সুষম খাদ্যাভ্যাস : ইফতার ও সেহরীতে কি খাবেন, কি খাবেন না

রোজায় সাধারণ পানাহার এবং অন্যান্য ক্ষতিকর খাদ্যদ্রব্য এবং পানীয় গ্রহণে বিরত থাকার ফলে দেহ ডিটক্সিফিকেশনের জন্য পর্যাপ্ত সময় ও সুযোগ পায়। এর ফলে পরিপাকতন্ত্র সচল হয় এবং রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক থাকে। একই সাথে দেহ থেকে যাবতীয় বিষাক্ত পদার্থ দূর হয়ে যাবার ফলে দেহে কোন ব্যথা অনুভূত হয়না।

২। রোজা কোলেস্টেরলের মাত্রা স্বাভাবিক করে

সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতের কিছু কার্ডিওলজিস্টের গবেষণা মোতাবেক, যারা নিয়মিত রোজা থেকেছেন এবং পর্যাপ্ত সুষম খাবার খেয়েছেন, তাদের দেহের লিপিড প্রোফাইল (lipid profile) একদম স্বাভাবিক। অর্থাৎ, তাদের রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কম।

এছাড়াও কিছু গবেষণা থেকে আরো জানা গিয়েছে যে, রোজা রাখার ফলে দেহে হাই ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন কোলেস্টেরল (high-density lipoprotein cholesterol) এর মাত্রা বেড়ে যায় এবং  লো ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন কোলেস্টেরল (low-density lipoprotein cholesterol) এর মাত্রা হ্রাস পায়।

দেহে কোলেস্টেরলের মাত্রা স্বাভাবিক থাকলে যেকোন হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাকের মত ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। এছাড়াও, রোজার পুরোটা সময়ে যদি একটি সুষম ডায়েট চার্ট অনুসরণ করা যায়, সেটি স্বাস্থ্যের সুরক্ষায় আরো উপকারী একটি বিষয়।

৩। রোজা মেটাবোলিজমে সাহায্য করে

রোজা রাখার ফলে আমাদের লিভারে থাকা এনজাইমগুলো ভেঙে কোলেস্টেরলে পরিণত হয়। একই সাথে দেহে জমে থাকা ফ্যাট বার্ন হয়ে বাইল এসিড (bile acid) এ রূপান্তরিত হবার ফলে দেহে তাপ উৎপন্ন হয়। এর ফলে দেহে মেটাবলিজম বুস্ট হয় এবং ক্ষুধা কম লাগে।

বলে রাখা ভাল, বাইল এসিড হচ্ছে লিভার বা যকৃত দ্বারা তৈরি একপ্রকার এসিড। এটি পিত্তের সাথে কাজ করে দেহের ফ্যাট বার্ন করতে সাহায্য করে।

৪। রোজা ওজন হ্রাসে সহায়ক

ওজন হ্রাস রোজার বৈজ্ঞানিক উপকারিতা গুলোর মাঝে অন্যতম। পূর্বেই উল্লিখিত, দীর্ঘসময় ধরে রোজা অর্থাৎ পানাহার থেকে বিরত থাকার ফলে আমাদের দেহ তার প্রয়োজনীয় শক্তি আহরণের জন্য দেহের বিভিন্ন ফ্যাটি টিস্যু এবং মাংসপেশী ও লিভারে জমে থাকা অতিরিক্ত গ্লুকোজ বার্ন করে দেয়। এর ফলে দেহের ওজন হ্রাস পায় এবং শারীরিক গঠন স্বাভাবিক ও সুঠাম থাকে।

জর্ডানের ৬০ জন স্বাস্থ্যবান মুসলিম ব্যক্তির উপর চালানো গবেষণা থেকে দেখা গিয়েছে যে, পুরো মাসজুড়ে রোজা থাকার ফলে অবশেষে তাদের দেহের ওজন হ্রাস পেয়েছে। এমনকি এতে তাদের দেহের কর্টিসল (cortisol), টেস্টোস্টেরন (testosterone), ইলেকট্রোলাইটস (electrolytes), ট্রাইগ্লিসারাইডস (triglycerides) এর উপর কোন প্রভাব পড়েনি।

গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, নিয়মিত রোজা রাখার ফলে অতিরিক্ত ওজনের অধিকারী ব্যক্তিরা স্বাভাবিক ও কম ওজনের ব্যক্তিদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি ওজন হ্রাসে সক্ষম হয়েছেন। এছাড়াও যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নন, তারা গড়ে প্রায় ১.৭-৩.৮ কেজির মত ওজন ঝরাতে পেরেছেন বলেও প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে।

আরো পড়ুন:  রোজার সুষম খাদ্যাভ্যাস : ইফতার ও সেহরীতে কি খাবেন, কি খাবেন না

সুতরাং ওবেস (obese) বা স্থুলকায় ব্যক্তিদের জন্য শারিরীক সুস্থতায় রোজা বেশ স্বাস্থ্যসম্মত ও উপকারী একটি শারীরিক অভ্যাস।

৫। রোজা অতিরিক্ত ক্ষুধা নিবারণ করে

রোজার পুরো সময়টিতে পানাহার থেকে বিরত থাকা এবং সুষম খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের দেহ ঘনঘন ক্ষুধার্ত বোধ না করায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে রোজা শেষ করে ইফতার গ্রহণের সময় আমরা বেশি খাদ্যগ্রহণে অনীহাবোধ করি এবং পাকস্থলী সংকুচিত থাকার ফলে আমরা প্রয়োজনের চেয়ে কম খাবার খেয়ে সন্তুষ্ট থাকি। পরিমিত খাদ্যাভ্যাসের কারণে কম খেয়েও আমাদের দেহ পরিপূর্ণ থাকে, থাইরয়েড হরমোনের উৎপাদন স্বাভাবিক থাকে এবং মেটাবোলিজম বুস্ট হয়।

৬। রোজা পুষ্টি শোষণে কার্যকর

দীর্ঘসময় ধরে রোজা রাখায় এবং গভীর রাতে সাহরী করার ফলে আমাদের দেহে অ্যাডিপোনেক্টিন (adiponectin) নামক একটি হরমোন তৈরি হয়। এর ফলে আমাদের বিপাকক্রিয়ার কার্যকারিতা আরো সচল হয় এবং আমাদের দেহ এবং মাংসপেশী খাদ্য থেকে বেশি পুষ্টি শোষণে সক্ষম হয়।

তবে গর্ভবতী এবং সদ্য মা হওয়া নারীদের জন্য রোজার পুরো সময়টিতে দেহে পর্যাপ্ত পুষ্টি এবং শক্তি গ্রহণের বিষয়টি বেশ জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ।

৭। রোজা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে

রোজার বৈজ্ঞানিক উপকারিতা গুলোর মাঝে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা হলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি। আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা মূলত শ্বেত রক্তকণিকা দ্বারা পরিচালিত। রোজা রাখার ফলে পুরনো শ্বেত রক্তকণিকাগুলো পুনরায় পুনরোজ্জীবিত হয় এবং আগের চেয়েও স্বাস্থ্যকর ও দৃঢ় রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠে।

এছাড়াও, রোজার পরে ইফতারে পুনরায় খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের দেহের স্টেম সেলগুলো আবারো সজীব হয়ে উঠে। ফলশ্রুতিতে দেহ সতেজ ও সুস্থ থাকে।

৮। রোজা রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখে

রোজায় সাধারণ খাদ্যাভ্যাস পরিহারের মাধ্যমে খাবারের সাথে অতিরিক্ত লবণ গ্রহণের মাত্রাও কমে যায়। এছাড়াও রেচন প্রক্রিয়ায় দেহের অতিরিক্ত লবণ বের হয়ে যায় বলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।

আরো পড়ুন:  রোজার সুষম খাদ্যাভ্যাস : ইফতার ও সেহরীতে কি খাবেন, কি খাবেন না

৯। টাইপ টু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক

শারীরিক সুস্থতায় রোজা রাখার অন্যতম বিজ্ঞানসম্মত উপকারিতা পাওয়া যায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে। স্বল্প পানাহারের কারণে রক্তে অতিরিক্ত গ্লুকোজের মাত্রা কমে যায়। এর ফলে টাইপ টু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়।

১০। অকাল বার্ধক্যের ঝুঁকি কমায়

রোজা রাখার ফলে আমাদের দেহের অপ্রয়োজনীয় কোষগুলো ধ্বংস হয় এবং পুনরায় দেহের জন্য প্রয়োজনীয় কোষ এবং টিস্যু গঠিত হয়। এই সাধারণ প্রক্রিয়ার ফলে দেহে কোলাজেন (collagen) উৎপাদনের হার বৃদ্ধি পায় এবং দেহত্বক আরো উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত হয়।

১১। খারাপ খাদ্যাভ্যাস দূর করে

রোজা রাখার সাথে জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের বেশ দারুণ একটি সম্পর্ক আছে। প্রথমত, রোজা রাখার ফলে আমরা দীর্ঘসময় পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকি।

এর ফলে ধূমপান, জাংক ফুড এবং মদ্যপান থেকেও বিরত থাকা সম্ভব। দ্বিতীয়ত, ইফতার এবং সাহরীতে সুষম খাদ্যাভ্যাসের তালিকা মেনে চলার ফলে আমরা খুব সহজেই সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপনে সক্ষম হতে পারি।

১২। রোজা মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে

শুধু শারীরিক দৃষ্টিকোণ থেকেই যে রোজা আমাদের দেহের জন্য উপকারী বা গুরুত্বপূর্ণ তা কিন্তু নয়। রোজায় পর্যাপ্ত মানসিক বিকাশ অর্জনের ফলে মস্তিষ্কের প্রয়োজনীয় নিউরোট্রফিক ফ্যাক্টরের (neurotrophic factor) পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এর ফলে মস্তিষ্কের কোষের বৃদ্ধিসাধন হয় এবং মস্তিষ্ক আরো কর্মক্ষম হয়।

১৩। মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশ নিশ্চিতকরণ

রোজা রাখার বৈজ্ঞানিক উপকারিতাই শুধু নয়, এই উপকারিতাটি আপনি নিজেও উপলব্ধি করতে পারবেন। মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমাদের মানসিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতেও রোজার বিকল্প নেই। রোজা আমাদের মনকে প্রফুল্ল রাখে এবং স্বচ্ছ মানসিক অবস্থা নিশ্চিত করে। এটি প্রাথমিকভাবে ঘটে মূলত সঠিক মাত্রায় ক্যালরি, লবণ এবং শর্করাজাতীয় খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে।

দ্বিতীয়ত, রোজার সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় আমাদের দেহ এন্ডোরফিন (endorphin) নামক রাসায়নিক উপাদানে পরিপূর্ণ থাকে। এর ফলে আমাদের দেহে মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত হয় এবং দীর্ঘসময় পর্যন্ত আমাদের মন প্রফুল্ল থাকে।

তৃতীয়ত, রোজা রাখার ফলে এড্রেনাল গ্রন্থি থেকে উৎপাদিত কর্টিসল হরমোন এর হার তুলনামূলকভাবে কমে যাওয়ায় একজন ব্যক্তি কম মানসিক চাপ অনুভব করেন। এর ফলে মন দুশ্চিন্তামুক্ত থাকে এবং ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।

রোজার বৈজ্ঞানিক উপকারিতা নিয়ে শেষ কথা

রোজা যে শুধু একটি ধর্মীয় চর্চাই তা কিন্তু নয়। অধ্যবসায়, সংযম এবং দেহের সার্বিক সুস্থতা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমাদের জীবনযাত্রার মান উন্নতিতে রোজার গুরুত্ব অপরিসীম, এবং কোন বিকল্পই নেই।

তাই, আমাদের উচিত নিয়মিত ইবাদতের পাশাপাশি পরিমিত খাদ্যাভ্যাস, রোজার সুষম ডায়েট চার্ট মেনে এবং যথার্থ বিশ্রামের সাথে রোজা পালন করা, রোজার বৈজ্ঞানিক উপকারিতা গুলো সঠিকভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করা।

2 thoughts on “রোজার বৈজ্ঞানিক উপকারিতা ও শারীরিক সুস্থ্যতায় গুরুত্ব”

    1. অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া! প্রতিবর্তনের সাথেই থাকুন! 😊

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top