প্যারেন্টিং কি? শিশুর সুস্থ্য মানসিক বিকাশে সঠিক প্যারেন্টিং

সঠিক-প্যারেন্টিং

প্যারেন্টিং” শব্দটার সাথে আমরা অনেকেই খুব বেশি পরিচিত নই। কিন্তু প্যারেন্টিং বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সন্তান জন্মদান আর সন্তান লালন-পালন এক জিনিস নয়। আমরা সাধারনত সন্তানের শারীরিক স্বাস্থ্যটাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকি, শিশুর মানসিক সুস্থতার দিকে গুরুত্ব কমই দেই।

একটা শিশু যখন ছোট থেকে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে আমরা তখন তার শারীরিক সুস্থতা ও বিকাশ নিয়ে চিন্তা করি, কিন্তু বলতে গেলে মানসিক সুস্থতা বা বিকাশের দিকে লক্ষ্যই রাখি না।

সন্তানের আচার-ব্যবহার, মানসিক গ্রোথসহ অনেক কিছুই সন্তানের ছোটবেলা তথা প্যারেন্টিং এর উপর নির্ভর করে। ছোটবেলায় পাওয়া শিক্ষা প্রত্যেক শিশুই সারাজীবন আঁকড়ে ধরে থাকে। আর যথাযথ প্যারেন্টিং’ই পারে সন্তানের ছোটবেলাটা সুন্দর করতে।

প্যারেন্টিং কি | What is Parenting?

সহজ ভাষায় বলতে গেলে, প্যারেন্টিং হলো একজন পিতা বা মাতা হিসেবে শিশুর শারীরিক, মানসিকসহ সার্বিক বিকাশের দিকে লক্ষ্য রাখা এবং সেই অনুযায়ী তাকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করা।

আমরা ভাবি, প্যারেন্টিং শেখার কোনো বিষয় না, এটি আপনা আপনিই হয়ে থাকে। আসলে তা নয়, প্যারেন্টিং এ শেখার অনেক কিছু আছে। বর্তমান জেনারেশনে good parenting, bad parenting সম্পর্কে জানা আরো বেশি জরুরি।

এই যুগটা খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে, যার ফলে আমাদের বাবা-মা এবং আমাদের মাঝে বিশাল একটা জেনারেশন গ্যাপ রয়েছে। এবং এই গ্যাপের সাথে সাথে বুঝাপড়ারও একটা গ্যাপ হয়ে যাচ্ছে।

প্যারেন্টিং নিয়ে আজ এমন কিছু আলোচনা করব, যা হয়ত আমরা এতটা ভেবে বলি না কিন্তু তা আমাদের সন্তানের উপর বিশাল একটা প্রভাব ফেলে যা তার ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য ক্ষতিকর।

১. শিশুর মানসিক বিকাশে বাধা দিচ্ছে লেখাপড়ার অতিরিক্ত চাপ

বর্তমান যুগে সকল Parents ছেলেমেয়ের লেখাপড়া নিয়ে অনেক সচেতন। সকাল থেকে কোচিং, প্রাইভেট, স্কুল আবার বাসায় এসে হোম টিউটর, সারাদিন এইভাবেই লেখাপড়ার মধ্যে দিয়ে কেটে যায়। এর বাইরে খেলাধুলা বা অন্যান্য প্রতিভাগুলো বিকাশের সুযোগ দেয়া হয় না।

কখনো কখনো একটা সাবজেক্ট এর জন্য একাধিক শিক্ষকও রাখি আমরা। কিন্তু একবার ও ভেবে দেখি না এত চাপ আমাদের সন্তান নিতে পারছে কিনা বা তার ধারন ক্ষমতা কতটুকু, সে কি চায়।

এই লেখাপড়ার চাপে আমাদের সন্তানদের অনেক প্রতিভা চাপা পড়ে যায়। এর চাপের ফলে হয়তো আপনার বাচ্চার ইদানিং রাগ, জেদ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। এটা Bad Parenting, আপনার সন্তানের সুস্থ্য মানসিক বিকাশে অতিরিক্ত চাপ না দিয়ে স্বাধীনতা দিন। সন্তান মানসিকভাবে বিকশিত হলে অতিরিক্ত পড়ার দররকার হবেনা।

২. সন্তান ও প্যারেন্ট এর মাঝে পারস্পরিক আন্ডারস্ট্যান্ডিং

আমরা পিতা-মাতা সাধারনত আমাদের সন্তানদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরন করি না। নিজেদের অজান্তেই আমরা আমাদের এবং আমাদের সন্তানদের মাঝে একটা দেয়াল তৈরী করে ফেলি। সন্তান যা করছে ভুল করছে, আমরাই সবসময় ঠিক এমন চিন্তা আমাদের জেঁকে বসে আছে।

আমরা ভাবি যে তাদের সাথে বন্ধুর মত আচরন করলে আমাদের সম্মানটা কমে যাবে। আসলে তা নয়, তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরন করলে আমাদের সম্মানটা আরো বাড়বে আর পারিবারিক সম্পর্কটাও সুদৃঢ় হবে।

সন্তানের পাশে থেকে উপলব্ধি করান জীবনের প্রতিটা সময়েই বাবা মাকে প্রয়োজন, parents কোনো বোঝা নয়। তাহলে হয়তো কোনো সন্তান বৃদ্ধাশ্রমে বাবা-মাকে পাঠানোর চিন্তা করবেনা।

এখনকার ছেলেমেয়েরা বাবা মাকে সব কথা বলেনা, বলতে পারেনা। কারন একটাই তাদের ধারনা বাবা-মা সেই বিষয়টা বুঝবে না। এই যে একটা দেয়াল, এটা যদি না থাকে তাহলে দেখা যাবে সন্তানরা সব কথাই বাবা মায়ের সাথে শেয়ার করছে এবং তাদের অনেক সমস্যাই কমে যাচ্ছে। আর বাবা মায়ের ও সন্তানদের নিয়ে দুশ্চিন্তা অনেকাংশে কমে আসছে।

কিন্তু শেয়ারিং বিষয়টা একদিনে আসে না। একজন এডাল্ট মানুষকে মোটিভেট করার চেয়ে বাচ্চাকে মোটিভেট করা অনেক সহজ, বাবা-মা হিসেবে আরো বেশি সহজ।

তাই সন্তানের সাথে বন্ধুত্ব করতে চাইলে ছোটবেলায় করুন এবং সেটা অটুট রাখুন। সন্তানদেরকে বুঝতে দিন পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা আপনি, আপনার সাথে সবকিছু শেয়ার করা যায়।

৩. অন্যদের সাথে তুলনা

আমাদের সমাজের সকল যুগের প্যারেন্টস ( parents ) ই এই কাজটা খুব বেশি করি। অন্যদের সাথে নিজের সন্তানকে তুলনা করি। এই কাজটা প্রায় সব বাবা-মা ই করে থাকেন, কিন্তু এটাই সবচেয়ে বড় একটা ভুল প্যারেন্টিং ( bad parenting )।

আমাদের একটা ভুল ধারনা যে অন্যের সাথে তুলনা করলে আমাদের সন্তানের জিদ হবে, সেও তাদের মত হবে বা তাদেরকে দেখে অনুপ্রাণিত হবে।

আসলে তা নয়, এইভাবে তুলনা করার ফলে সন্তানদের মাঝে এক ধরনের হীনমন্যতা, হতাশা তৈরি হয়। তারা নিজেদের প্রতি আত্নবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, নিজেদের ছোট ভাবতে শুরু করে।

এইভাবেই মূলত বাচ্চারা কাজের প্রতি আগ্রহ হারায়, নিজের প্রতি বিশ্বাস হারায়। এই বয়সে প্রতিজ্ঞা করার চেয়ে রাগ, প্রতিহিংসা বেশি জন্মায়।

আমাদের বাবা-মায়ের মাঝে আরো একটি প্রচলিত bad parenting ( ভুল প্যারেন্টিং ) নিজের দুই সন্তানের মাঝে তুলনা। কখনো ভেবে দেখেছেন কি, আপনার আজকের এই তুলনা আগামীতে আপনার দুই সন্তানের মাঝে সম্পর্ক নষ্টের মূল কারণ হবে। কেউ কারো সাফল্যে আনন্দিত হবে না। একে অপরের সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে যাবে এবং এর কারণ আপনি!

মনে রাখতে হবে, সবাই আলাদা, সবার আলাদা আলাদা ব্যাক্তিত্ব রয়েছে। সবার নিজস্ব প্রতিভা রয়েছে, কেউ গানে, কেউ নাচে কেউবা অন্য কোনো দিকে দক্ষ। কার কি প্রতিভা আছে, সেটা খুজে সেই দিকে ফোকাস করলে ভালো ফলাফল আশা করা যায়। সন্তানদেরকে কখনো অন্য কারো সাথে তুলনা করবেন না।

What is Good Parenting? – সন্তানের প্রতিভা বিকাশে সঠিক প্যারেন্টিং

সন্তানের-মানসিক-বিকাশ

সবার-ই ভিন্ন ভিন্ন প্রতিভা রয়েছে। লেখাপড়ার পাশাপাশি অন্যান্য প্রতিভা বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেয়া উচিত। অনেক সময় আমরা শুধু একাডেমিক শিক্ষার দিকেই নজর দেই। খেলাধুলা, নাচ, গান, আবৃত্তি, ড্রয়িং এমন অনেক প্রতিভা লুকায়িত আছে অনেকের মাঝেই।

শিশুর কি ইচ্ছা, তারা কি চায়, কোন কাজটা করতে তারা আনন্দ উপভোগ করে এসব লক্ষ্য করতে হবে। আর সেই অনুযায়ী তাদেরকে কাজ করতে দিতে হবে, এতে করে তাদের মানসিক বিকাশ এবং প্রতিভা বিকাশিত হবে। এটাই Good Parenting.

১. শিশুর ইচ্ছা-অনিচ্ছার গুরুত্ব দেয়া

প্রায় সময়ই আমরা সন্তানদের ইচ্ছার গুরুত্ব দেই না। তারা ছোট, বুঝবে না, বুঝে না এমন ভাবি আমরা। বাবা মা অবশ্যই সন্তানদের ভালো চায়, কিন্তু সন্তানদেরকেও তাদের ভালো মন্দ বুঝতে দেয়া উচিত।

তারা কি চায়, কিভাবে চায়, তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার গুরুত্ব দেয়া উচিত। তাদের যে কোনো সিধান্তে তাদেরকে সহযোগিতা করা উচিত। তারা যেন নিজের সঠিক-ভুল বিবেচনা করতে পারে এমনভাবে তাদেরকে গড়ে তুলতে হবে।

2. শিশুকে সবসময় দোষারোপ না করা

সবসময় দোষারোপ করলে শিশুর মানসিক বিকাশে বাধা পায়। আমরা সবসময়ই আমাদের সন্তানদের বলি এইটা করো নাই কেন? ওটা করছো কেন?

আমার কথা শুনো নাই বলে এমন হইতেসে, আজকে আমার কথা শুনলে এমন হইত না, বাবা মায়ের কথা না শুনলে এমন ই হয়। এইরকম আরো কিছু কথা বলি আমরা। এতে যে সন্তানদের উপর কত খারাপ একটা প্রভাব পড়ে তা আমাদের ধারনারও বাইরে।

তারা কোনো ভুল করলে আমরা বলেই যাই এটা ভুল, এটা কেন করলা এইসব কী। কিন্তু কখনো তার ভুলটা শুধরে দেই না। তাকে বুঝার চেষ্টা করি না, তাকে বুঝানোর চেষ্টা করি না। সে ভুল, এতটুকু বলেই আমাদের দায়িত্ব শেষ বলে আমরা মনে করি। কিন্তু এতে সন্তানের মানসিক বিকাশে ব্যাঘাত ঘটে, শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয়।

ভালো প্যারেন্টিং হলো আপনার সন্তানকে নতুন নতুন স্টেপ নিতে উৎসাহ দেওয়া, তাকে ভুল করতে দিন এবং ভুল করার পর শুধরে দিন। এবং আবারও নতুন কোন ভুল করতে দিন।

ছোটবেলায় করা সন্তানের ভুলগুলো আপনার বাচ্চার জীবন ধ্বংস করবে না। যদি সে তার ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিতে পারে, তবে ভবিষ্যতে তাকে কেউ আটকাতে পারবেনা।

প্যারেন্টিং নিয়ে শেষ কথা

শিশুর মানসিক বিকাশে Good Parenting খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। শারীরিক বিকাশের পাশাপাশি শিশুর মানসিক দিক ঠিক রাখতে হলে Good Parenting এর বিকল্প নেই।

শুধুমাত্র একটু বুঝে শুনে খেয়াল করে বাচ্চাদের সাথে আচরন করলে তাদের জীবনটা সুন্দর ভাবে বিকশিত হতে পারে, নতুবা তাদের ভবিষ্যৎ জীবন অন্ধকারের দিকে ধাবিত হবে। প্রয়োজন হলে সাইকোলজিস্টের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে।

পিতা-মাতার প্যারেন্টিং ভূমিকার গুরুত্বের কারণেই ইউরোপ-আমেরিকায় এখন প্যারেন্টিং কোর্স বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এছাড়াও পারিবারিক বন্ধন সন্তানের সুস্থ্য মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ। তাই পারিবারিক বন্ধন বৃদ্ধি করতে চেষ্টা করুন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top