রোজার সুষম খাদ্যাভ্যাস: সিয়াম সাধনার মাস রমজান প্রায় আসন্ন। আর এ উপলক্ষে আমাদের দেশে শুরু হয়ে যায় হরেকরকম খাবার বানানোর প্রস্তুতি। কিন্তু ইফতার সেহরীতে কি খাবেন, কি খাবেন না তা নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেকেই সচেতন নন। রোজা রাখার বৈজ্ঞানিক উপকারিতা থাকা সত্ত্বেও রোজার সঠিক খাবার ও ডায়েট প্লান মেনে না চলায় বিভিন্নরকম সমস্যা দেখা দেয়।
তাই রোজায় ইফতার সেহরীতে খাবারের সকল প্রস্তুতি গ্রহণের আগে আমরা কতখানি ভেবে নিচ্ছি সেসব খাবারের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে? তাই, আসুন জেনে নেই রোজার জন্য সুষম খাদ্যগুলো কি কি।
একনজরে সম্পূর্ণ আর্টিকেল
রোজার সুষম ডায়েট প্ল্যান ও খাদ্যাভ্যাস
পুরো রমজান মাসজুড়ে আমরা কতরকম খাবার খাচ্ছি সেটাই মূখ্য বিষয় না। বিপাক ক্রিয়ার হার বৃদ্ধি করতে এবং দৈহিক কর্মক্ষমতা সচল রাখতে আমাদের দেহের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ অনুযায়ীই রোজার ডায়েট চার্ট সাজানো উচিত।
নিম্নোক্ত খাবারগুলোকে আমরা আমাদের রোজার ডায়েট চার্টের অন্তর্ভুক্ত করতে পারি।
১। পানীয় এবং জুস
- পানি: পানি হচ্ছে এমন একটি খাদ্য উপাদান, যা আমাদের দেহে কোনরূপ ক্যালরি বা শর্করা ছাড়াই হাইড্রেশন সরবরাহ করে। তাই রমজানের পুরো সময়জুড়েই আমাদের উচিত প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ খাবারের পাশাপাশি বেশি করে পানি পান করা।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, পুর্ণবয়স্কদের জন্য দৈনিক ৩-৪ লিটার পানি পান করা প্রয়োজন, যদিও শরীরের পক্ষে দরকারী পানির প্রায় ৪০ শতাংশই আমরা বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য, ফলের রস, শরবত এবং চা-কফি থেকে পেয়ে থাকি। অর্থাৎ, ইফতার থেকে সাহরীর সময় পর্যন্ত প্রতি ঘন্টায় কমপক্ষে ২ থেকে ৩ গ্লাস পানি পান করা উচিত।
- ফলের জুস: বিভিন্ন ফলের জুসে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ থাকে। ভিটামিন, মিনারেল এবং ক্যালরির এই সঠিক সমন্বয় আমাদের দেহকে সতেজ ও সচল রাখে।
২। খেজুর
আমাদের নবী করিম (সাঃ) তাঁর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রতিবারই খেজুর দিয়ে ইফতার শুরু করতেন। প্রকৃত অর্থেই খেজুর ইফতার শুরু করার একটি দুর্দান্ত উপায়, কেননা এটি উচ্চমাত্রার ফাইবারসমৃদ্ধ একটি সুষম খাবার। আর আমরা জানি, ফাইবারসমৃদ্ধ খাবারগুলো দীর্ঘসময় ধরে পেট ভরা রাখে, যার ফলে ক্ষুধা কম লাগে। এছাড়াও খেজুর পরিপাকক্রিয়া সচল রাখে এবং হজমে সহায়তা করে।
ভিটামিন বি এর পাশাপাশি খেজুরে রয়েছে শরীরের পক্ষে দরকারী সব খনিজ উপাদান যেমন পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ ইত্যাদি।
খেজুরের খাওয়ার নানারকম স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পর্কে জানতে আমাদের আর্টিকেলটি পড়ে নিতে পারেন।
৩। ড্রাই ফ্রুটস
রোজার ডায়েট লিস্টে খেজুরের পাশাপাশি অ্যাপ্রিকট, ডুমুর, কিসমিসের মত ড্রাই ফ্রুটসও রাখা যেতে পারে। এসব ড্রাই ফ্রুটস প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক শর্করা এবং ফাইবারসমৃদ্ধ হওয়ায় মেটাবলিজম বুস্ট করে এবং ক্ষুধা নিবারণ করে।
৪। ফল
দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতিতে বিভিন্ন ফলফলাদির সমাহার ইফতারের টেবিলের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, মিনারেল ছাড়াও পানির ভাগ বেশি হওয়ায় দেহের পানির চাহিদা অনেকাংশেই পূরণ হয়। ইফতার বা সাহরির মেন্যুতে তরমুজ, বাঙ্গি, পেয়ারা, নাশপাতি ইত্যাদি ফল রাখা উচিত।
৫। স্যুপ
ঐতিহ্যগতভাবে সৌদি আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের ভিভিন্ন দেশসমূহে মাংসের স্ট্যু এবং স্যুপ ইফতারের খাবার হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। এসব স্যুপে আরবরা বিভিন্ন শস্য যেমন ডাল, শিমের বীচি ইত্যাদি প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার ব্যবহার করে, যার ফলে এটি বেশ পুষ্টিকর হয়ে থাকে।
৬। সালাদ
রোজায় যথাসম্ভব ভাজাপোড়া জাতীয় খাবার এড়িয়ে বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর সালাদ খাওয়া শরীরের পক্ষে উপকারী। ডায়েটেশিয়ানদের মতে, আপেল, পেয়ারা, কিসমিস, কমলালেবু এবং বিভিন্ন প্রকারের বাদাম দিয়ে বানানো ফ্রুট সালাদ ডায়েট চার্টে রাখা যেতে পারে। এছাড়াও শশা, গাজর, টমেটো, বাঁধাকপি ইত্যাদি সবজি দিয়েও সালাদ বানিয়ে রাখতে পারেন আপনার ইফতার টেবিলে।
৭। হোলগ্রেইন (wholegrain) শস্য
লাল গমের আটা কিংবা ওটস ইফতার কিংবা সাহরির ডায়েট লিস্টে রাখা জরুরি। এগুলোতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকায় বিপাকক্রিয়ার হার নিয়ন্ত্রিত থাকে।
৮। টকদই
টকদইতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি, প্রোটিন, ক্যালসিয়াম এবং আয়োডিন। এতে জলীয় অংশ অনেক বেশি থাকায় পানির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি খাবার হজমেও বেশ সহায়ক।
টকদই দিয়ে ফলের স্মুথি বানানোর পাশাশি বিভিন্ন সালাদ এবং ওটসের সাথে টকদই মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে।
৯। পনির
দুগ্ধজাত খাবারের মাঝে পনিরে রয়েছে প্রচুর প্রোটিন এবং ভিটামিন ডি। তবে পনির খাবার আগে অবশ্যই নিশ্চিত হওয়া উচিত এটি লবণাক্ত কিনা। যদি পনিরে লবণের পরিমাণ বেশি থাকে, তবে সেটি পরিহার করাই ভাল।
১০। বাদাম
আখরোট, কাঠবাদাম ইত্যাদি বাদামে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে উদ্ভিজ্জ ফ্যাট এবং ক্যালসিয়াম। বাদাম ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার হওয়ায় এটি মেটাবলিজম বাড়ায় এবং অল্পেই ক্ষুধা নিবারণ করে।
WHO অর্থাৎ World Health Organization অনুযায়ী, উপরোক্ত আলোচনার আলোকে এবং ইসলামী সুন্নাহ মোতাবেক একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির রোজার সুষম খাদ্যাভ্যাস বা ইফতার ও সাহরির মেন্যু কি হতে পারে নিম্নরূপ:
ইফতার মেন্যু / ইফতারে যা খাওয়া উচিৎ
খাবারের নাম | পরিমাণ |
খেজুর | তিনটি |
তাজা কমলার জুস | আধা কাপ |
ভেজিটেবল স্যুপ (পাউডার স্যুপ ব্যতীত) | এক কাপ |
ক্র্যাকার বিস্কুট/বাকরখানি | দুইটি |
সবজ শাকসবজি দিয়ে বানানো সালাদ (অলিভ অয়েল যুক্ত) | এক বাটি |
মুরগির বুকের মাংস (বেকড/গ্রীলড) | পরিমাণমত |
সাহরির মেন্যু / সাহরিতে যা খাওয়া উচিৎ
খাবারের নাম | পরিমাণ |
লাল চালের ভাত | এক কাপ |
ব্রাউন ব্রেড/পূর্ণ গমের তৈরি রুটি (ভাতের বদলে) | দুইটি |
ভেজিটেবল অমলেট/কড়া সিদ্ধ ডিম | একটি |
সবুজ শাকসবজি দিয়ে বানানো সালাদ (অলিভ অয়েল যুক্ত) | এক চতুর্থাংশ কাপ |
খোসাসহ আপেল বা যেকোন মৌসুমি ফল | একটি |
টকদই (চিনি ব্যতীত) | তিন চতুর্থাংশ কাপ |
চিনি ছাড়া যেকোন ভেষজ চা | এক কাপ |
রোজায় যা খাওয়া উচিত নয়
পুরো রমজান মাসজুড়ে সচরাচর আমরা সেসব খাবারই প্রস্তুত করে থাকি, যা আমাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। কখনোবা অসাবধানতার বশে, আবার কখনোবা জেনে বুঝেও আমরা এসব খাবার ইফতার এবং সাহরীতে গ্রহণ করে থাকি এবং ফলে বিভিন্ন শারীরিক জটিলতার শিকার হই। তাই এখন আলোচনা করব রোজায় কি কি খাওয়া উচিত নয় সে ব্যাপারে।
১। তেলে ভাজা খাবার
বিভিন্ন ইসলামিক দেশে, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ঐতিহ্যগতভাবে ভাজাপোড়া খাবার ইফতারিতে বেশ প্রচলিত। এসব খাবারে প্রচুর পরিমাণে ফ্যাট এবং ক্যালরি থাকায় সারাদিন রোজা শেষে দীর্ঘ ক্লান্তির পর এসব খেলে গ্যাস্ট্রিক, এসিডিটির মত অন্যান্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ডুবো তেলে ভেজে খাবার তৈরির চেয়ে ডায়েটিশিয়ানরা নিম্নোক্ত প্রক্রিয়ায় খাবার তৈরির পরামর্শ দিয়ে থাকেনঃ
- ভাপে তৈরি/সেদ্ধ
- বেক করা
- গ্রীল করা
- হালকা তেলে স্টার ফ্রাই করা (stir-frying)
২। অতিরিক্ত মিষ্টিজাতীয় খাবার
রোজায় আমরা রসনাবিলাসের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মিষ্টিজাতীয় খাবার খেয়ে থাকি, যা করা একদমই উচিত নয়। বিশেষ করে ইফতারের পরপর মিষ্টিজাতীয় খাবার এবং সুগার সিরাপ এড়িয়ে চলা উচিত।
মিষ্টিজাতীয় খাবারের পরিবর্তে খেজুর, তরমুজ, নাশপাতি ইত্যাদি মিষ্টি ফল খাওয়া যেতে পারে।
৩। লবণাক্ত খাবার
অনেক সময় অসাবধানতার বশে আমরা রোজার খাদ্যতালিকায় বিভিন্ন লবণাক্ত খাবার রেখে থাকি। যেমনঃ
- সসেজ
- বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত এবং লবণাক্ত মাছ/মাংস
- পিকেলস বা আচার
- বিভিন্ন রেডিমেড ক্র্যাকার্স
- সসজাতীয় খাবার (টমেটো কেচাপ, মেয়োনেজ, মাস্টার্ড সস ইত্যাদি)
- লবণাক্ত পনির/মাখন
World Health Organization (WHO) কর্তৃক প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এসব খাবার যথাসম্ভব পরিহার করে চলা উচিত। কেননা এসব লবণাক্ত খাবার আমাদের তৃষ্ণা বাড়ায়। ফলে রোজা রাখার পুরো সময়টিতে আমরা ক্লান্তি অনুভব করি।
৪। অতিরিক্ত ক্যাফেইন যুক্ত পানীয়
আমরা অনেকেই ইফতারের সময় চা, কফি কিংবা কোকাকোলার মত পানীয় গ্রহনে অভ্যস্ত। এসব পানীয়তে ক্যাফেইনের মাত্রা বেশি থাকায় এগুলো গ্রহনের ফলে প্রস্রাবের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলশ্রুতিতে ঘন ঘন তৃষ্ণা পাওয়া থেকে শুরু করে দেহে ডিহাইড্রেশনের মত জটিলতা দেখা দেয়।
এছাড়াও কোকাকোলা, স্প্রাইট ইত্যাদি সফট ড্রিংকসে ক্যালরির পরিমাণ বেশি থাকায় দেহে প্রচুর পরিমাণে ফ্যাটি টিস্যু জমতে থাকে। এর ফলে মেটাবলিজম বুস্ট হয়না এবং ওজন বৃদ্ধি পায়।
শেষ কথা
আমাদের উপমহাদেশের একটি ধর্মীয় ঐতিহ্য হচ্ছে রোজা পালন। এসময় অভ্যাসবশত কিংবা সাংস্কৃতিক চর্চাবশত আমরা ভাজাপোড়া জাতীয় জাংক ফুড তৈরি করলেও আমাদের উচিত ইফতার ও সেহরীতে পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবার খাদ্যতালিকায় রাখা।
সেইসাথে রোজার সুষম খাদ্যাভ্যাস বাকি মাস গুলোতেও মেনে চলা। আর এভাবেই রোজা আমাদের সুস্বাস্থ্য, অধ্যবসায় এবং দৃঢ় মনোবল গঠনে সক্ষম।