থানকুনি পাতার দারুন সব উপকারিতা আলোচনা করার আগে থানকুনি পাতার পরিচয় সম্পর্কে সামান্য জেনে নেওয়া দরকার। থানকুনি পাতার (Thankuni Pata) বৈজ্ঞানিক নাম centella asiatica. নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে এই হার্বটি এশিয়ার নেটিভ। প্রাচীনকাল থেকেই থানকুনি পাতার বিস্তৃতি এশিয়া মহাদেশের জলাশয় কিংবা এর আশে পাশে।
গ্রাম-গঞ্জে কিংবা রাস্তাঘাটের আশেপাশে বড় অযত্ন আর অবহেলায় থানকুনি পাতা প্রচুর পরিমাণে জন্মে থাকে। আধুনিক চিকিৎসার গ্যাড়াকলে আয়ুর্বেদ বা কবিরাজি চিকিৎসা হারাতে বসলেও এই থানকুনি পাতার উপকারিতার কথা এখনো দাদা-দাদী, নানা-নানীদের মুখে মুখে শোনা যায়।
আপনিও যদি থানকুনি পাতার দারুন সব উপকারিতা সম্পর্কে জানতে চান তাহলে আঁটঘাট বেঁধে বসে পড়ুন। আর্টিকেলটিতে থানকুনির উপকারিতা ও অপকারিতা, থানকুনি পাতার পুষ্টিগুণ এবংথানকুনি পাতা খাওয়ার নিয়ম নিয়েও আলোচনা করবো ইন-শা-আল্লাহ।
একনজরে সম্পূর্ণ আর্টিকেল
থানকুনি পাতার দারুন সব উপকারিতা
চিকিৎসা ব্যবস্থার এই প্রভূত উন্নতির আগে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যার সমাধানে থানকুনি পাতার ব্যবহার ছিলো চোখে পড়ার মতো। চলুন থানকুনি পাতার দারুন সব উপকারিতা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
১. থানকুনি পাতা ক্ষতের চিকিৎসায় কার্যকর
শরীরের কোথাও কেটে গেলে বা ক্ষতের সৃষ্টি হলে সেখানে থানকুনির পাতার পেস্ট ম্যাসাজ করলে দারুণ উপকার পাওয়া যায়।
থানকুনি পাতায় থাকা saponins নামক উপাদান ক্ষতস্থানের রক্ত প্রবাহের মাত্রা বৃদ্ধি করে। ফলে রক্ত জমাট বাধানোর ফ্যাক্টরগুলো দ্রুত কার্যকর হয়ে ওঠে এবং রক্ত জমাট বেধে যায়। এভাবে থানকুনি পাতা রক্ত জমাট বাধানোর কাজে সহায়তা করে।
২. শরীরের প্রদাহের মাত্রা কমায়
থানকুনি পাতায় আছে নানা ধরনের অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান। যা শরীরের নানা ধরনের প্রদাহ জনিত সমস্যায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নিয়মিত থানকুনি পাতা খাওয়ার অভ্যাস এই ধরনের সমস্যা প্রতিরোধে সহায়ক হয়।
৩. পেটের সমস্যা প্রতিরোধে সাহায্য করে
প্রাচীন কাল থেকে থানকুনি পাতার সবচাইতে বেশি ব্যবহার হতো এই পেটের সমস্যায়। ডায়রিয়া, আমাশয়, পাকস্থলীর প্রদাহ কিংবা আলসার সব সমস্যায়ই সাধারণ ঔষধ ছিলো এই থানকুনি পাতা। এতে থাকা এন্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান এই সব রোগের প্রকোপ কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
৪. মানসিক অবসাদ ও দুশ্চিন্তা প্রতিরোধক
থানকুনি পাতায় থাকা উপাদান মানসিক অবসাদ দূর করার ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। এই উপাদান মস্তিষ্কের serotonin নামক হরমোনের ক্ষরণ বাড়ায় যা cortisol হরমোনের মাত্রা কমিয়ে আনে।
এই cortisol হরমোন মূলত স্ট্রেস হরমোন হিসেবে পরিচিত। এর মাত্রা কমার সাথে সাথে মানসিক অবসাদও কমে আসে এবং মানসিক স্বস্তির পাশাপাশি যেকোনো দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
৫. থানকুনি পাতা মস্তিষ্কের ক্ষমতা বাড়ে
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর অবশ্য কোনো যুক্তি পাওয়া যায়নি। তবে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় একে মস্তিষ্কের ক্ষমতা বৃদ্ধিকারক বলা হয়েছে।
নিয়মিত থানকুনি পাতার ব্যবহারে মানুষের চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি পায়। শিশুদের ক্ষেত্রে এটা সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখে বলে আয়ুর্বেদ চিকিৎসকরা বলে থাকেন।
৬. থানকুনি পাতা অনিদ্রা দূর করে
আপনি ইনসোমনিয়ায় ভুগছেন? বন্ধুবান্ধবরা ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে বলছে? তারপর ডাক্তার দেখানোর সাথে সাথে হরেক রকমের ঔষধ লিখা একটি প্রেসক্রিপশন ও পেয়েছেন!
থামুন!! এই সব ঔষধে আছে নান রকমের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া যা তাৎক্ষণিকভাবে আপনার ইনসমনিয়ার সমস্যা দূর করবে বটে কিন্তু আপনাকে বড় ধরনের শারীরিক সমস্যার দিকে ধাবিত করবে ক্রমেই।
তার চাইতে আপনি যদি নিয়মিত থানকুনি পাতা খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন তবে এটাই আপনার জন্য উত্তম হবে।
নিয়মিত থানকুনি পাতার ব্যবহার অনিদ্রা জনিত সমস্যা দূর করে। মস্তিষ্কের serotonin হরমোনের বৃদ্ধি এই সমস্যা দূর করে। আর থানকুনি পাতায় থাকা উপাদান এই কাজটিই করে থাকে।
৭. শরীরের বিষাক্ত পদার্থ দূর করে থানকুনি পাতা
শরীরের Toxic cleanser হিসেবে থানকুনি পাতার উপকারিতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, দৈনন্দিন ঘাম ও মুত্রের সাথে শরীরের নানা ধরনের বিষাক্ত উপাদান শরীরের বাইরে নির্গত হয়। তবে, কিছু উপাদান আছে যাদের আমাদের বৃক্ক বা কিডনি মুত্রের সাথে বের করে দিতে পারে না। এসব দিনের পর দিন শরীরেই জমে থাকে।
প্রথম প্রথম হয়তো বোঝা যায় না তবে যখন বোঝা যায় তখন বড় ধরনের কোনো রোগ আকারে দেখা দেয় এবং কিছুই করার থাকে না।
অথচ, নিয়মিত থানকুনি পাতা খাওয়ার অভ্যাস এই সমস্যা থেকে নিষ্কৃতি দিতে পারে। এতে থাকা এন্টি-টক্সিক উপাদান সমূহ আমাদের শরীরে জমে থাকা টক্সিন গুলোকে মুত্রের মাধ্যমে দেহের বাইরে নিষ্কাশন করে শরীরকে দীর্ঘমেয়াদে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে।
প্রতিদিন সকালে খালি পেটে ২ চা চামচ থানকুনি পাতার রসের সাথে ১ চা চামচ মধু মিশিয়ে খেলে এই ধরনের টক্সিন থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
৮. জ্বরের চিকিৎসায় থানকুনি পাতা
বলুন তো হঠাৎ আপনার জ্বর উঠলে আপনি কি করেন? নিশ্চয়ই চট করে হাতের কাছে থাকা প্যারাসিটামলের মোড়কটা খুলে একটা খেয়ে ফেলেন। ফলাফলে আপনার জ্বরটা কমে যায়। শরীর সুস্থ তো আপনিও খুশি!
কিন্তু আপনি কি জানেন নিজের হাতেই আপনি কত বড় একটা ক্ষতি করে ফেললেন? এই প্যারাসিটামলের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ায় আপনার কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। শুনে হয়তো ভাবতে পারেন, একটা দুইটা বড়ি আর এমন কি ক্ষতি করবে।
ঠিক! একটা দুইটায় তেমন ক্ষতি করবে না। কিন্তু, এমন করে যে আপনি সারাজীবনে কত কেজি প্যারাসিটামল খেয়ে ফেলবেন তার হিসাব হয়তো আপনি করতে পারবেন না কিন্তু আপনার কিডনি ঠিকই করতে পারবে। তখন আপনার তেমন কিছু করার ও থাকবে না।
অথচ, এই থানকুনি পাতায় আছে জ্বরের প্রতিষেধক। হয়তো প্যারাসিটামলের মতো তড়িৎ কাজ করবে না, তাতে কি! একটু সময় নিলেও পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার হাত থেকে তো বাঁচলেন।
জ্বরের চিকিৎসায় থানকুনি পাতার এক চামচ রসের সাথে শিউলি পাতার এক চামচ রস মিশিয়ে খেলে বেশ উপকার পাওয়া যায়।
৯. রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে থানকুনি পাতার উপকারিতা
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে থানকুনি পাতার ভূমিকা রয়েছে। যেহেতু এটা ভেষজ তাই তাৎক্ষনিক কাজ করবে না এটাই স্বাভাবিক।
সেজন্য, প্রতিদিন নিয়ম করে নির্দিষ্ট পরিমাণ পাতা খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। তাহলে, হঠাৎ প্রেশার বেড়ে যাওয়া কিংবা নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশেই হ্রাস পাবে।
বিশেষ করে যাদের পারিবারিক ইতিহাসে অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপের সমস্যা আছে তাদের জন্য এই পদ্ধতি হতে পারে চমৎকার সমাধান।
১০. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক
নিয়মিত থানকুনি পাতা খাওয়ার অভ্যাস ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে। যারা খুব তাড়াতাড়ি মুটিয়ে যাচ্ছেন তাদের জন্য ওজন কমাতে নিয়মিত থানকুনি পাতা খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলার বিকল্প নেই।
থানকুনি পাতার অপকারিতা
থানকুনি পাতার দারুন সব উপকারিতা থাকলেও অনিয়মিত ব্যবহারে থানকুনি পাতার অপকারিতাও রয়েছে। কি কি ক্ষতি সাধন করতে পারে এখন তা জেনে নেওয়া যাক;
- অনিয়মিত কিংবা একসাথে অনেকটা পরিমাণ থানকুনি পাতা খেয়ে নিলে প্রচন্ড পেট ব্যথা হতে পারে।
- এর অনিয়মিত ব্যবহার মাথা ঘোরা জনিত সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
- অ্যালার্জির সমস্যা যাদের আছে তাদের না খাওয়াই উত্তম।
- অনিয়মিত ব্যবহারে ব্লাডপ্রেসার ফল্ট করতে পারে।
- যাদের লিভারের সমস্যা আছে তাদের জন্য থানকুনি পাতা উপকারের চাইতে ক্ষতিই বেশি করবে। তাই তাদের না খাওয়াই উত্তম।
- খুব শীঘ্রই কোনো অপারেশন হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে থানকুনি পাতা এড়ানো উচিত।
থানকুনি পাতা খাওয়ার নিয়ম
থানকুনি পাতার দারুন সব উপকারিতা সম্পর্কে তো জানলেন! এখন, থানকুনি পাতা খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কেও তো জানা দরকার! তাহলে চলুন থানকুনি পাতা খাওয়ার নিয়ম ও কয়েকটি সহজ রেসেপি জেনে নেই।
থানকুনি পাতার শিল পাটায় বেটে ভর্তা বানিয়ে খেতে পারেন, থানকুনি পাতার বড়া তৈরী করতে পারেন। থানকুনি পাতার বড়া খেতে বেশ সুস্বাদু। এছাড়া, আপনি থানকুনি পাতার শরবতও তৈরী করতে পারেন। থানকুনি পাতার শরবতের স্বাস্থ্য উপকারিতা সবচেয়ে বেশি। এছাড়া থানকুনি পাতা খাওয়ার আরো কিছু নিয়ম হলো;
- গ্যাস্ট্রিক সমস্যা দূর করতে থানকুনি পাতা কাঁচা দুধের সাথে মিক্স করে খাওয়া হয়।
- খুশখুশি কাশি থেকে মুক্তি পেতে থানকুনির পাতা মিক্স করে খাওয়া হয়।
- থানকুনির পাতা ভর্তা করে খাওয়া যায়।
- সকালে থানকুনির পাতা রস করে বা চিবিয়ে খেলে আমাশয় সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাবেন।
- রক্ত পরিষ্কার করতে মধুর সাথে মিশিয়ে থানকুনির রস খেতে পারেন।
- লিভারের সমস্যায় প্রতিদিন সকালে থানকুনির রস ১ চামচ, ৫/৬ ফোঁটা হলুদের রস, সামান্য পরিমাণ চিনি ও মধুসহ ১ মাস খেলে লিভারের সমস্যা ভালো হয়।
থানকুনি পাতার দারুন সব উপকারিতা নিয়ে শেষ কথা
তো পাঠক! কি বুঝলেন আজকের প্রবন্ধটি থেকে। অবহেলা অনাদরে জন্মে যে ভেষজে আপনার জন্য এত ফায়দা লুকানো তা বাদ দিয়ে আমরা এমন সব ঔষধ-পথ্যের ছুটছি যা সাময়িক সুবিধা দিলেও চূড়ান্তভাবে আপনাকে ঠেলে দিবে মৃত্যুর মুখে।
যাইহোক! আপনি যদি আমাদের আজকের লেখাটি পড়ে থানকুনি পাতার দারুন সব উপকারিতা ও গুরুত্ব উপলব্ধি করে নিয়মিত খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন তবেই লেখাটির স্বার্থকতা।
থানকুনি পাতার অনেক উপকার জানলাম। ধন্যবাদ আপনাকে
আপনাকেও ধন্যবাদ, প্রতিবর্তনের সাথেই থাকুন