আয়কর রিটার্ন হচ্ছে কোনো ব্যাক্তির বাৎসরিক আয়ের সংক্ষিপ্ত বিবরণ আয়কর কর্তৃপক্ষের নিকট তুলে ধরার মাধ্যম। অর্থাৎ, আপনি যা আয় করেন, যেভাবে আয় করেন ও যেখান থেকে করেন তার একটা বিবরণ সরকারকে জানানোর উপায় হচ্ছে আয়কর রিটার্ন। প্রতি বছর নভেম্বরের ৩০ তারিখ হচ্ছে আয়কর রিটার্ন দাখিলের শেষ দিন। আয়কর রিটার্ন দাখিলের নিয়ম জানা থাকলে আপনি ঘরে বসে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন।
যাদের করযোগ্য পরিমাণ আয় রয়েছে এবং যাদের আবশ্যিকভাবে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হয় তারা এই আয়কর বিবরণী জমা দেবেন। মূলত তাদের জন্য কিভাবে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হয় তা জানা দরকার।
একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে কিভাবে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হয় তা জেনে রাখা উচিৎ। কারন, আমাদেরকে কোনো না কোনো সময় আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে। তাই যদি আগেই জেনে রাখা যায় তাহলে খুব সহজেই কাজটি সমাধান করতে পারব। আজকের এ লেখায় আমরা কিভাবে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হয় তা জেনে নিবো।
আপনি আয়কর রিটার্ন দাখিল দুই ভাবে করতে পারেন। এক, অনলাইন থেকে এবং সরাসরি আয়কর কর্তৃপক্ষের নিকট গিয়ে।
অনলাইন থেকে যদি করতে চান তাহলে এই www.etaxnbr.gov.bd সাইট থেকে আয়কর রিটার্নের ফর্ম ডাউনলোড করে নিতে পারেন।
- উল্লেখিত ওয়েবসাইটিতে প্রবেশ করার পর নিচের পেইজের মতো একটি পেইজ আসবে। এ পেইজ থেকে e-Return অপশনে ক্লিক করবেন।
Guideline অপশনে ক্লিক করে গাইডলাইনগুলো পড়ে নিবেন। এতে তাদের অন্যান্য নিয়ম ও নির্দেশনাগুলো জেনে নিতে পারবেন।
গাইডলাইন সম্পূর্ণ পড়ার পর আপনাকে এবার একটি একাউন্ট খুলে নিতে হবে। একাউণ্ট খুলতে আপনার টিএনআই নাম্বার লাগবে। এবং একটি পাসওয়ার্ড দিয়ে একাউন্ট খুলে নিবেন।
সাইন ইন সম্পূর্ন হলে এরকম একটি ইন্টারফেইজ আসবে। এটার মানে, আপনার একাউন্টটি খোলা সম্পূর্ন হয়েছে। এবার নিচের সাইন ইন অপশনে ক্লিক করবেন।
সাইন ইন করার পর একটা ফর্ম আসবে যেখাবে বিভিন্ন অপশন দেয়া থাকবে যা আপনার বিভিন্ন তথ্যদি দিয়ে ফিলাপ করতে হবে। নতুন কিছু চাইলে দিয়ে দিবেন বা কোনো তথ্য যদি এডিট করতে হয় তাহলে এডিট করে নিচে ‘ সেইভ এন্ড কন্টিনিউ’ অপশনে ক্লিক করবেন।
যেহেতু আমরা রিটার্ন দাখিল করব সেজন্য ডান পাশের ‘ রিটার্ন সাবমিশন ‘ অপশনে ক্লিক করে বা পাশের ফর্মটি যথাযথ তথ্য দিয়ে পূরণ করব। যে অর্থ বছরের রিটার্ন জমা দিবেন সে বছর সিলেক্ট করবেন।
লাল দিয়ে দেখানো অপশনটিতে বলা হচ্ছে, আপনার কি কোনো রেমিট্যান্স আয় আছে কিনা। যদি থাকে তাহলে ‘ইয়েস’ দিবেন না থাকলে ‘নো’ দিবেন। বিশেষ করে যারা ফ্রিল্যান্সিং করেন বা ফেসবুক-ইউটিউবে কন্টেন্ট বানান তারা ‘ইয়েস’ দিবেন।
এবার ডান পাশে চলে আসুন। প্রথম অপশনটিতে আপনার আয়ের সোর্স চাইবে। যে সোর্স থেকে আয় করেন সেই সোর্সে ক্লিক করবেন। স্যালারি হলে স্যালারি অপশন কিংবা বাড়ী ভাড়া হলে বাড়ী ভাড়া। অথবা, যদি এমন হয় যে আপনার আয়ের সোর্স এখানে নেই তাহলে সবার শেষের অপশনটি সিলেক্ট করে দিবেন।র
তার নিচে লাল দেয়া অপশনটি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। আপনি যদি মুক্তিযোদ্ধা হোন তাহলে এই অপশন সিলেক্ট করবেন।
মুক্তিযোদ্ধা অপশনের নিচের অপশনটি প্রতিবন্ধীদের জন্য সিলেক্ট করবেন। প্রতিবন্ধী হিসেবে যদি ব্যাক্তির কোনো আয় থাকে তাহলে এই অপশনটি তাদের জন্য।
আপনার যদি কোনো ডিপিএস থাকে এবং তার সুদ যদি ইনকাম ট্যাক্স দেয়ার মতো হয় তাহলে এখানে ‘ইয়েস’ সিলেক্ট করবেন।
ডান পাশের বক্সে প্রথম অপশনে বলা আছে, যদি আপনার মোট সম্পত্তি ৪০ লাখ টাকার বেশি থাকে তাহলে ‘ ইয়েস ‘ দিবেন না থাকলে ‘নো ‘ দিবেন।
তার নিচের অপশনে বলা আছে যদি আপনার নিজের গাড়ী থাকে তাহলে ‘ ইয়েস ‘ দিবেন না থাকলে ‘ নো’ দিবেন।
সবার শেষের অপশনে বলা আছে, কোনো সিটি কর্পোরেশন এলাকায় আপনার নিজের বাড়ী আছে কিনা। যদি থাকে তাহলে ‘ ইয়েস ‘ দিবেন না থাকলে ‘ নো’ দিবেন।
এখানে যদি আপনি ‘ইয়েস’ দেন তাহলে আপনাকে উপরের দেয়া তথ্যগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত লিখে দিতে হবে। সেটা অনেকের কাছে ঝামেলার মনে হতে পারে। ঝামেলা এড়াতে ‘নো’ দিতে পারেন। তাহলে অটোমেটিক আপনার সম্পত্তির হিসাব নিজেরাই করে নিবে।
আপনাকে আয়ের সোর্স লিখে দিতে হবে। যে অথিরিটির মাধ্যমে টাকা এসেছে সেই অথিরিটির নাম লিখবেন। কোন তারিখের মধ্যে এসেছে সেটাও উল্লেখ করে দিবেন। এটা সাধারণত আপনার শেষ ট্যাক্স জমা দেয়ার পরের তারিখ থেকে শুরু হবে। পরের ঘরে কত টাকা আয় হয়েছে তা দিয়ে দিবেন। শেষের ঘরে দিবেন সেই টাকা বাবদ কোনো ট্যাক্স দিয়েছেন কিনা তা লিখে দিবেন।
এসব লেখার পর আপনার নেট ইনকাম অটোমেটিক কাউন্ট হবে।
এরপর ‘ সেইভ এন্ড কন্টিনিউ ‘ অপশনে ক্লিক করে পরের পেইজে যাবেন।
এখানে আপনার কোথাও ইনভেস্ট আছে কিনা তা চাইবে। ডিপিএস থাকলে ডিপিএস অপশন সিলেক্ট করবেন। অন্য কোথাও ইনভেস্ট থাকলে সেটা সিলেক্ট করবেন।
ডিপিএস সিলেক্ট করলে, নিচে কয়েকটা ঘর আসবে। সেখানে ব্যাংকের নাম, একাউন্ট নাম্বার এবং এমাউন্ট দিয়ে ঘর পূরণ করে ‘ সেইভ এন্ড কন্টিনিউ ‘ অপশনে ক্লিক করে দিবেন।
এই পেইজে আপনার যাবতীয় খরচের হিসাব উল্লেখ করে দিবেন। অর্থাৎ, আপনার আয়ের টাকা কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যয় হয় তার হিসাব। সবগুলো ঘর পূরণ করে ‘ সেইভ এন্ড কন্টিনিউ ‘ অপশনে ক্লিক করবেন।
এরপর এই পেইজ আসবে। এখানে আপনার জমাকৃত তথ্যের উপর ভিত্তি করে কতটাকা জমা দিতে হবে তা আসবে।
এক্ষেত্রে, আপনি আরেকবার সব তথ্যগুলো আরেকবার চেক করে নিবেন। যদি কোনো তথ্য ভুল হয়ে থাকে তাহলে নিচে ‘ Draft ‘ অপশনে ক্লিক করে সেভ করে প্রথম পেইজ থেকে বা যেখানে ভুল আছে তা ঠিক করে একেবারে নিচে ‘ Pay Now ‘ অপশনে ক্লিক করবেন। আপনি চাইলে যেকোনো মোবাইল ব্যাংকিং বা ব্যাংক একাউন্ট থেকে টাকা পরিশোধ করতে পারবেন।
আর যদি টাকার অংক ‘০’ দেখায়, তাহলে নিচের ‘ proceed to online return ‘ অপশনে ক্লিক করবেন।
ক্লিক করার পর একটা পূর্নাঙ্গ ফর্ম আসবে। যেখানে আপনি যা যা উল্লেখ করেছেন তার সব দেয়া থাকবে। ফর্মের নিচে ‘ Final Submission ‘ অপশনে ক্লিক করবেন।ফাইনাল সাবমিশনে ক্লিক করার পর ‘ Submit Return ‘ অপশনে ক্লিক করে দিবেন। এর আগে ভ্যারিফিকেশন বক্সে খালি বক্সে একটা ক্লিক করে টিক চিহ্ন দিয়ে দিবেন।
রিটার্ন সাবমিট হলে উপরে ‘ ইয়েস-নো’ অপশন আসবে। সেখান থেকে ‘ ইয়েস ‘ দিয়ে দিবেন।
ইয়েস অপশনে ক্লিক করার পর ডাউনলোড অপশন আসবে সেখান থেকে ফর্মটি ডাউনলোড করে নিবেন।
অনলাইনের মাধ্যমে উপরে উল্লেখযোগ্য উপায়ে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন।
এবার আমরা আলোচনা করব কিভাবে সশরীরে আয়কর অফিসে গিয়ে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে। প্রথমে বলে রাখি কখন আয়কর রিটার্ন জমা দিতে পারবেন। পুরাতন করদাতারা এই বছরের ৩০ শে জুলাই থেকে নভেম্বরের ৩০ তারিখ পর্যন্ত বিনা জরিমানায় রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন। সময় সীমা পার হয়ে গেলে উপ-কর কমিশনারের নিকট দরখাস্ত লিখে সময় সীমা বাড়ানোর আবেদন করতে হবে।
তবে যারা নতুন আছেন তারা এই বছরের জুলাই থেকে শুরু করে আগামী বছরের ৩০ শে জুন ২০২৩ পর্যন্ত দিতে পারবেন।
তবে যদি এমন হয় যে, যারা বিগত বছরের করযোগ্য আয়ের রিটার্ন দাখিল করেনি তারা কিন্তু আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত সময় পাবেন না।
আয়কর রিটার্ন ফরম কোথায় পাওয়া যায়?
বাংলাদেশের সকল আয়কর অফিসে আয়কর রিটার্নের ফর্ম বিনামূল্যে পাওয়া যায়। করদাতা ব্যাক্তি সারা বছরই এই ফর্ম সংগ্রহ করতে পারেন।
কোথায় আয়কর রিটার্ন ফরম দাখিল করতে হয়?
রিটার্ন দাখিল করার জন্য আয়কর সার্কেল নির্দিষ্ট করা আছে।
➤ যারা ঢাকা জেলার বাসিন্দা এবং বেসামরিক সরকারি ও পেনশনভুক্ত কর্মচারী ও যাদের নাম A,B,C অক্ষর দিয়ে শুরু তারা কর অঞ্চল ৪ ও ঢাকা কর সার্কেল ৭১ এ রিটার্ন দাখিল করতে হবে।
➤ যারা নতুন করদাতা তারা তাদের নাম, প্রতিষ্ঠান ও চাকুরিস্থলের ঠিকানা ভিত্তি করে নির্ধারিত সার্কেলে টিএনআই উল্লেখ করে রিটার্ন দাখিল করতে হবে।
➤ করদাতা নির্ধারণ সময়ে যদি বিদেশে অবস্থান করে তাহলে উক্ত দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসে রিটার্ন দাখিল করতে পারবে।
➤ করদাতাগণ প্রয়োজনে আয়কর অফিস বা কর পরামর্শ কেন্দ্র থেকে যাবতীয় তথ্য জেনে নিতে পারে।
রিটার্ন দাখিল না করলে কী হবে?
আপনি যদি রিটার্ন দাখিল না করেন তাহলে বিভিন্ন সরকারি সেবা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। যেমন,
➤ যে সকল ক্ষেত্রে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ দেখানো বাধ্যতামূলক সেসব ক্ষেত্রের সেবা থেকে বঞ্চিত হবেন। যেমন, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ পাবেন না। ক্ষেত্রবিশেষে, বেতন-ভাতাদি পেতেও সমস্যা হতে পারে।
➤ নির্ধারিত সময়ে আয়কর রিটার্ন দাখিল না করলে তার উপর আয়কর অধ্যাদেশ ১২৪ ধারা অনুযায়ী জরিমানা, ৭৩ ধারা অনুযায়ী সরল সুদ এবং ৭৩A ধারা অনুযায়ী বিলম্ব সুদ আরোপ হবে।
➤ করদাতা কর- উপকমিশনারের কাছ থেকে মঞ্জুরকৃত সময়ে রিটার্ন দাখিল করবে তার জন্য জরিমানা আরোপ করা হবে না তবে বিলম্ব সুদ আরোপ হবে।