শারীরিক অবসাদ দূর করার উপায় : আমাদের কর্মব্যস্ত এই জীবনে ক্লান্তি বা শারীরিক অবসাদ খুবই সাধারণ একটি ব্যাপার। সাধারণত জ্বর কিংবা ঠান্ডা-সর্দিজনিত কারণে আমরা শারীরিক অবসাদ অনুভব করে থাকি। কিন্তু কখনো কি আপনি ভেবে দেখেছেন, কেন আপনি এতটা ক্লান্ত অনুভব করছেন আপনার অব্যাহত শারীরিক অবসাদের পেছনে ঠিক কি কি কারণ লুকিয়ে থাকতে পারে?
শারীরিক অবসাদ দূর করার উপায় জানার আগে আসুন জেনে নেই এই শারীরিক অবসাদ বা fatigue কি, এবং এর কারণসমূহ এবং অবসাদ দূর করার উপায় কি।
একনজরে সম্পূর্ণ আর্টিকেল
What is Fatigue | ফ্যাটিগ কি?
অনেকেই শারীরিক অবসাদ, বা ফ্যাটিগকে ঘুম ঘুম ভাব বা নিদ্রাজনিত কারণে ঝিমুনির সাথে তুলনা করে থাকেন।
কিন্তু, ফ্যাটিগ শুধুমাত্র ঝিমুনির মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। মেডিকেল টার্মে ফ্যাটিগ শব্দটি দিয়ে আমাদের দেহের শক্তিহীনতার ফলে সৃষ্ট দীর্ঘমেয়াদী ক্লান্তি, শ্রান্তি বা অবসাদকে বোঝানো হয়ে থাকে।
এই অবসাদের ফলে আমাদের শরীরই শুধু আক্রান্ত হয় তা নয়, বরং আমাদের মন ও মস্তিস্ক দুটোই প্রেরণাহীন এবং নিস্পৃহ হয়ে পড়ে।
বলে রাখা ভালো, নিদ্রাজনিত ঝিমুনি কিংবা ঘুম ঘুম ভাব দুটোই অনেকক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক অবসাদের লক্ষণ।
ফ্যাটিগ এর প্রকারভেদ
ফ্যাটিগ মূলত শারীরিক ও মানসিক—এই দুই রকমের হয়ে থাকে।
যারা শারীরিক অবসাদ বা ফ্যাটিগে ভুগে থাকেন, তাদের ক্ষেত্রে সাধারণ শারীরিক ক্রিয়াকলাপে অনেক সমস্যা হয়ে থাকে; যেমন সিঁড়ি বেয়ে উঠানামা, ভারী বা মাঝারি ওজনের জিনিস বয়ে তোলা ইত্যাদি। এক্ষেত্রে চিকিৎসক সাধারণত কিছু স্ট্রেংথ টেস্ট বা শারীরিক শক্তি পরীক্ষার মাধ্যমে ডায়াগনোসিস শুরু করেন।
অপরদিকে, মানসিক অবসাদ বা ফ্যাটিগে আক্রান্ত রোগীরা তাদের জীবনে ঘটতে থাকা ঘটনাসমূহের প্রতি আগ্রহ ও মনোযোগ দুটোই হারাতে থাকেন। ফলশ্রুতিতে তাদের ঘন ঘন ঝিমুনি এবং কাজের সময় জেগে থাকা প্রায় কষ্টকর হয়ে পড়ে।
শারীরিক অবসাদ বা ফ্যাটিগের কারণ সমূহ
ফ্যাটিগের পেছনে মূলত আমাদের লাইফস্টাইল এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বহুবিধ বিষয় নির্ভরশীল। যেমন:
১। মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়
“ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন” (clinical depression) টার্মটির সাথে কমবেশি আমরা সকলেই পরিচিত। এর সাথে সংশ্লিষ্ট আরেকটি বহুল প্রচলিত জটিল বিষয় হচ্ছে ইনসমনিয়া (insomnia)। ফ্যাটিগ বা শারীরিক অবসাদ মূলত ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন এবং ইনসমনিয়া—এ দুটো ব্যাপারের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বলা যেতে পারে, ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন নামক এই মারাত্মক ব্যাধির একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হচ্ছে ফ্যাটিগ।
এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকা কোন ব্যক্তির মানসিক দুঃশ্চিন্তা বা গ্লানির কারণেই এই দীর্ঘমেয়াদি ফ্যাটিগ হয়ে থাকে।
এছাড়াও আরো বেশকিছু মানসিক কারণের ফলে ফ্যাটিগ হয়ে থাকে। সেগুলো নিম্নরূপঃ
- মানসিক চাপ, উদ্বেগ বা দুঃশ্চিন্তা, ডিপ্রেশন
- মানসিক ক্লান্তি বা অবসাদ
- ইটিং ডিজঅর্ডার (eating disorder) বা খাওয়া-দাওয়া সংক্রান্ত জটিলতা যেমন অ্যানোরেক্সিয়া (anorexia), বুলিমিয়া (bulimia) ইত্যাদি
- শোকগ্রস্ততা (সম্পর্কের ভাঙন বা জটিলতা, প্রিয়জনের মৃত্যু কিংবা চাকরি হারানো ইত্যাদি)
- একঘেয়েমিতা
- সিজনাল এফেক্টিভ ডিজঅর্ডার (seasonal affective disorder)
- পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন (Postpartum depression)
২। শারীরিক জটিলতা বা রোগ
বেশকিছু শারীরিক জটিলতাও ফ্যাটিগের পক্ষে অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। যেমন:
- অ্যানেমিয়া (anemia) বা রক্তশূন্যতা
- আর্থ্রাইটিস (arthritis) বা বাত
- ফাইব্রোমায়ালজিয়া (fibromyalgia)
- ক্রোনিক ফ্যাটিগ সিনড্রোম (chronic fatigue syndrome)
- কোভিড-১৯ (COVID-19)
- ঠাণ্ডা এবং ফ্লুজনিত সংক্রমণ
- অ্যাডিসন’স ডিজিজ (Addison’s disease), যা দেহের হরমোনের অসামঞ্জস্যতা ঘটায়
- ওবেসিটি বা শারীরিক স্থুলকায়তা
- পিসিওএস (PCOS) অর্থাৎ পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (Polycystic ovary syndrome)
- হাইপোথাইরয়েডিজম
- হাইপারথাইরয়েডিজম
- হাঁপানি (asthma)
- অ্যালার্জিক রাইনিটিস (allergic rhinitis)
- অ্যাররিথমিয়াস (arrhythmias)
- অটো-ইমিউন ডিজঅর্ডার (autoimmune disorder)
- কনজেস্টিভ হার্ট ফেইলিওর (congestive heart failure)
- ক্রোনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (chronic obstructive pulmonary disease) বা সিওপিডি (COPD)
- এম্ফিসেমা (emphysema)
- কুশিং সিনড্রোম (Cushing’s syndrome)
- কোন কারণে অতিরিক্ত মাত্রায় রক্তক্ষরণ
- ইনফ্ল্যামেটরি বাউয়েল ডিজিজ (inflammatory bowel disease)
- দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার দুর্বলতা
- গ্যাস্ট্রোএসোফ্যাজিল রিফ্লাক্স ডিজিজ (gastroesophageal reflux disease)
- গর্ভকালীন অবস্থায়
- দেহে বেশকিছু ভিটামিন ও মিনারেলের ঘাটতি দেখা দিলে (ভিটামিন বি ১২, ভিটামিন ডি, ফলিক এসিড, আয়রন ইত্যাদি)
বলে রাখা ভালো, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার রোগী এবং কিডনি ও লিভারের জটিলতাযুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও ফ্যাটিগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশ প্রবল। এছাড়াও টিউবারকিউলোসিস, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস কিংবা এইচ আই ভি ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট রোগের সংক্রমণেও রোগীর দেহ বেশ দুর্বল হয়ে পড়তে পারে, ফলশ্রুতিতে সে ফ্যাটিগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।
৩। লাইফস্টাইল সংক্রান্ত জটিলতা
আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় একটু স্থবিরতা আসলেই দেখা দেয় বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা। ফ্যাটিগ বা শারীরিক অবসাদও এর ভিন্ন নয়। যেসব লাইফস্টাইল সংক্রান্ত জটিলতার কারণে ফ্যাটিগ দেখা দেয় সেগুলো নিম্নরূপ:
- অতিরিক্ত এবং বিরতিহীন শারীরিক পরিশ্রম
- পর্যাপ্ত শারীরিক অনুশীলনের অভাব
- ঘুমের অভাব বা স্লিপ অ্যাপনিয়া (sleep apnea)
- খাওয়া-দাওয়ায় অনভ্যস্ততা
- সুষম খাদ্যাভ্যাসে অনীহা
- অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন
- ধূমপানে অভ্যস্ততা
- কোকেইনের মত অবৈধ ড্রাগস ব্যবহার
- মাত্রাতিরিক্ত ক্যাফেইন সমৃদ্ধ পানীয় সেবন করা (চা, কফি, সফট ড্রিংকস ইত্যাদি)
- নির্দিষ্ট কিছু ঔষধ সেবন (এন্টিডিপ্রেসেন্ট, এন্টিহিস্টামিন, কাশির ঔষধ, হরমোনাল কন্ট্রাসেপশন কিংবা বার্থ কন্ট্রোল পিল ইত্যাদি)
- জেট ল্যাগ ডিজঅর্ডার (Jet lag disorder)
- নারকোলেপসি (narcolepsy)
- রিফ্লাক্স এসোফ্যাজাইটিস (reflux esophagitis)
শারীরিক অবসাদ বা ফ্যাটিগ এর লক্ষণ
ফ্যাটিগের মূল লক্ষণ শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম করার সাথে সাথে ক্লান্তি ও অবসাদবোধ করা। একজন ব্যক্তি পর্যাপ্ত ঘুম বা বিশ্রামের নেয়া সত্ত্বেও তার দেহের ক্লান্তি যায় না, অর্থাৎ সে সতেজ অনুভব করে না। এই উপসর্গটিই মুখ্য।
এছাড়াও ঘরের দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজকর্ম সহ বাইরের অন্যান্য কাজ পরিচালনা করাও তাদের পক্ষে বেশ দুঃসাধ্য।
অবসাদের লক্ষণগুলো শারীরিক এবং মানসিক উভয়ই হতে পারে। সেগুলো নিম্নরূপ:
- দেহের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে মাংসপেশীতে ব্যথা অনুভূত হওয়া
- সবকিছুতে উদাসীনতা, অনীহা এবং কর্মউদ্দীপনার অভাব
- দিনের বেলায় তন্দ্রাচ্ছন্ন হওয়া, ঝিমুনি ভাব
- নতুন কাজে মনোনিবেশ করতে পারার অক্ষমতা, অমনোযোগিতা
- পেট ফাঁপা, পেটে ব্যথা, বমি, কোষ্টকাঠিন্য এবং ডায়রিয়ার মত গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল (gastrointestinal) সমস্যা
- প্রচণ্ড মাথাব্যথা
- মেজাজ খিটখিটে থাকা বা অকারণ বিরক্তি
- মুড সুইং
- অস্পষ্ট দেখতে পাওয়ার মত দৃষ্টি বিষয়ক সমস্যা
- কখনো জ্বর কিংবা শরীর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া
মূলত কঠোর শারীরিক পরিশ্রমের পরই এই লক্ষণগুলো প্রকট আকার ধারণ করে; বিশেষ করে পরিশ্রমের কয়েক ঘণ্টা পর কিংবা পরদিনই এই লক্ষণগুলো রোগীর দেহে দেখা দেয়।
এছাড়াও কিছু শারীরিক জটিলতার ক্ষেত্রে ফ্যাটিগের কিছু বিশেষ উপসর্গ দেখা দিতে পারে। যেমন:
- যারা হৃদরোগ, ফুসফুসজনিত জটিলতা এবং অ্যানেমিয়ায় ভুগছেন, তাদের ক্ষেত্রে অল্প পরিশ্রম সত্ত্বেও শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
- ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে পলিইউরিয়া (polyuria) অর্থাৎ ইউরিনেশনের মাত্রা বেড়ে যাওয়া সহ পলিডিপসিয়া (polydipsia) বা ঘন ঘন তৃষ্ণার্তবোধ করা, দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হওয়া ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।
- যারা হাইপোথাইরয়েডিজম এর রোগী, তাদের ক্ষেত্রে ত্বকের শুষ্কতা, ভঙ্গুর চুল এবং ঠান্ডা আবহাওয়ার প্রতি সংবেদনশীলতা একটি সাধারণ বিষয়।
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন?
ফ্যাটিগ মোটেও অবহেলা করার বিষয় নয়। কোন ব্যক্তি দু সপ্তাহ বা তার বেশি সময় যাবত ক্লান্তি অনুভব করলে তার অবশ্যই উচিত স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া। মূলত নিম্নোক্ত উপসর্গগুলো দেখা দেওয়া মাত্রই একজন ব্যক্তিকে সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়:
- দেহের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়েও বেশি বেড়ে যাওয়া
- অস্বাভাবিক হারে ওজন হ্রাস পাওয়া
- অল্প ঠাণ্ডাতেই সংবেদনশীল হয়ে পড়া
- নিজেকে প্রায়ই খুব ডিপ্রেসড এবং হতাশ আবিষ্কার করা
- প্রতিদিনই ঘুমাতে অসুবিধা হওয়া
তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফ্যাটিগের উপসর্গসমূহ বেশ মারাত্মক আকার ধারণ করে। সেগুলো নিম্নরূপঃ
- রেক্টাল ব্লিডিং (rectal bleeding) অর্থাৎ মলদ্বারে রক্তক্ষরণ
- রক্তবমি করা
- অতিরিক্ত মাথাব্যথা
- বুকে ব্যথা হওয়া
- অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
- অনিয়মিত হৃদস্পন্দন
- পিঠ, কোমর এবং পেটে ব্যথা অনুভূত হওয়া
- শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়া
- আত্মহত্যা কিংবা মানসিকভাবে আঘাত পেয়ে নিজের ক্ষতি করার প্রবণতা বেড়ে যাওয়া
- আজেবাজে চিন্তা আসা
উল্লিখিত উপসর্গসমূহ দেখা দিলে রোগীর অবশ্যই উচিত চিকিৎসকের পাশাপাশি যেকোন ডায়েটিশিয়ান এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া।
ফ্যাটিগের ডায়াগনোসিস
চিকিৎসকেরা সাধারণত ফ্যাটিগের কারণ এবং উপসর্গভেদে ফ্যাটিগের ডায়াগনোসিস ও চিকিৎসা শুরু করেন। ফ্যাটিগের ডায়াগনোসিস মূলত বেশ কয়েকটি ধাপের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হয়। সেগুলো নিম্নরূপ:
প্রথম ধাপ
চিকিৎসক সাধারণত প্রথম ধাপে রোগীকে বেশকিছু প্রশ্ন করে থাকেন। যেমন:
- সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর তারা সুস্থ অনুভব করে কিনা?
- ক্লান্তি এবং অবসাদের মাত্রা দিনের বেলা বাড়ছে কিনা?
- দিনের বেলা কোন কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছেন কিনা?
- দৈনিক ক্যাফেইন সমৃদ্ধ পানীয় পানের মাত্রা কতটুকু?
- ক্লান্তি কি ধীরে ধীরে নাকি হঠাৎই অপ্রত্যাশিতভাবে আসে?
- ক্লান্তি অনুভূত হওয়ার ব্যপ্তিকাল (দৈনিক/অনিয়মিত)?
- ক্লান্তি লাগার পরবর্তী শারীরিক জটিলতা হিসেবে কি কি অনুভব করছেন?
- ক্লান্তি লাগার ফলে মানসিকভাবে কি কি পরিবর্তন এসেছে?
- দিনের কোন সময়টিতে সবচেয়ে বেশি ক্লান্তি লাগে?
- ডায়াবেটিস, কিডনি, হার্ট, লিভার বা ফুসফুসজনিত সমস্যা আছে কিনা?
- লাইফস্টাইল সংক্রান্ত বিষয় (দৈনন্দিন খাদ্যাভাস, ঘুমের পরিমাণ, মদ্যপান বা ধূমপানের বদঅভ্যাস আছে কিনা ইত্যাদি)
- বিশেষ কোন ঔষধ সেবন করছেন কিনা, যার কারণে ফ্যাটিগ দেখা দেয়ার সম্ভাবনা প্রবল?
দ্বিতীয় ধাপ
প্রথম ধাপে করা প্রশ্নগুলোর উত্তরের ওপর ভিত্তি করে এ পর্যায়ে চিকিৎসক রোগীকে বেশকিছু ব্লাড টেস্টের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সেগুলো নিম্নরূপ:
- সিবিসি (CBC) বা কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (complete blood count) টেস্ট
- ইলেকট্রোলাইট (electrolyte) টেস্ট, যার মাধ্যমে দেহের খনিজ পদার্থ যেমন সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফ্লোরাইডের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়
- গ্লুকোজ বা ব্লাড সুগার টেস্ট
- কিডনি ঠিকমতো কাজ করছে কিনা তা বোঝার জন্য ক্রিয়েটিনিন (creatinine) টেস্ট
- থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন (thyroid stimulating hormone) বা TSH
- ভিটামিন ডেফিসিয়েন্সি টেস্ট (ভিটামিন বি ১২, ভিটামিন ডি, ফলিক এসিড ও আয়রনের ঘাটতি আছে কিনা তা বোঝার জন্য)
এছাড়াও ফ্যাটিগের অন্যান্য কারণ ও উপসর্গের ধরণ বুঝে চিকিৎসকেরা ইউরিন টেস্ট, এক্সরে, সিটি স্ক্যান, ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম (electrocardiogram), সিপিকে (CPK), ইএসআর (ESR) ইত্যাদি টেস্ট দিয়ে থাকেন, যাতে করে ফ্যাটিগের পেছনে কোন প্রচ্ছন্ন কারণ থাকলে তা বেরিয়ে আসে।
উল্লেখ্য, ফ্যাটিগের এই ডায়াগনোসিসগুলো চিকিৎসককে এটা বুঝতে সাহায্য করে যে রোগীর ফ্যাটিগটি ঠিক কোন পর্যায়ে গিয়েছে। পরবর্তীতে তিনি সে অনুযায়ীই রোগীকে ঔষধ প্রেসক্রাইব করে থাকেন।
শারীরিক অবসাদ দূর করার উপায়
ফ্যাটিগের সমাধান বা প্রতিকার যতটা না চিকিৎসানির্ভর, তার চেয়ে বেশি তা নির্ভর করে আমাদের সচেতনতা এবং উন্নত লাইফস্টাইলের ওপর।
শারীরিক অবসাদ দূর করার উপায় হিসেবে চিকিৎসকদের পরামর্শক্রমে ঔষধ সেবনের পাশাপাশি আমাদের উচিত নিম্নোক্ত সতর্কতাবিধি মেনে চলা।
১। পর্যাপ্ত ঘুমের অভ্যাস
দৈনন্দিন জীবনে নিদ্রাহীনতা একটি সাধারণ সমস্যা, যার ফলে ফ্যাটিগ খুব সহজেই আমাদের কাবু করে ফেলে। এর সমাধানে নিম্নলিখিত উপায়ে আমরা পর্যাপ্ত ঘুমের অভ্যাস গড়ে তুলতে পারি:
- প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং ঘুম থেকে ওঠা, এমনকি ছুটির দিনেও এই নিয়ম জারি রাখা।
- শোবার ঘরের তাপমাত্রা একটি আরামদায়ক পর্যায়ে সেট করা, সবচেয়ে ভালো হয় সহনীয় পর্যায়ের শীতল কক্ষে ঘুমের অভ্যাস গড়ে তুললে।
- ঘরটি যাতে নিরিবিলি, শান্ত এবং অন্ধকার হয় তা নিশ্চিত করা, কারণ অতিরিক্ত আলো ও শব্দে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে।
- ঘুমানোর অন্তত এক ঘণ্টা আগেই সকল প্রকার স্ক্রিনিং লাইটযুক্ত ডিভাইস ব্যবহার বন্ধ করা (মোবাইল, ল্যাপটপ, টেলিভিশন ইত্যাদি), যেহেতু এসব ডিভাইস থেকে নির্গত আলো ও শব্দ আমাদের মস্তিষ্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং এভাবেই স্বাভাবিক ঘুমের মাত্রা ব্যাহত হয়।
- ঘুমানোর আগমুহূর্তে খাওয়া থেকে বিরত থাকা। বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাতে ঘুমানোর অন্তত ২ ঘণ্টা আগে রাতের খাবার সেরে নেয়া ভালো।
- ঘুমানোর আগে উষ্ণ জলে স্নান করা। এতে করে রাতে ভালো ঘুম হয়।
- ঘুমানোর আগে সবসময় ইতিবাচক চিন্তা করার অভ্যাস করা, সকল প্রকার দুঃশ্চিন্তা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে চেষ্টা করা।
- ঘুমের আগে মানসিক চাপ বা উদ্বেগ থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে বিশেষজ্ঞরা কোন স্নিগ্ধ সঙ্গীত শোনার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
- ডায়াগনোসিসের সুবিধার জন্য একজন রোগীর উচিত তার ঘুমের অভ্যাস এবং আরো খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে ডায়েরিতে লিখে রাখা।
২। পর্যাপ্ত খাদ্যাভ্যাস
আমাদের খাদ্যাভ্যাসের অনিয়মিত চর্চাই আমাদের বেশিরভাগ শারীরিক সমস্যার জন্য দায়ী। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই কথাটি আমরা জানা সত্ত্বেও রোজই নিজেদের খাদ্যাভ্যাসের তালিকায় সুষম খাদ্য বা নিয়ম অন্তর্ভুক্ত করছি না।
নিম্নলিখিত উপায়ে আমরা সুষম খাদ্যাভ্যাস চর্চা করতে পারি:
- দিনে তিনবেলা ভরপেট না খেয়ে অল্প অল্প করে ঘন ঘন খাওয়া
- সুগার এবং ক্যালরি কম এমন জাতীয় হালকা খাবার খাওয়া (মুড়ি, যেকোন সবজির সালাদ, পপকর্ন, সেদ্ধ ডিম, যেকোন মৌসুমী ফল, বাদাম, খেজুর, ব্রাউন ব্রেডের সাথে পিনাট বাটার, পানি ঝরানো টকদই ইত্যাদি)
- একই সাথে ভারী খাবার, ফাস্ট ফুড এড়িয়ে চলা
- বিকেলে এবং সন্ধ্যায় অতিরিক্ত মাত্রায় ক্যাফেইন জাতীয় পানীয় গ্রহণে বিরত থাকা
৩। পর্যাপ্ত শারীরিক ক্রিয়াকলাপ
দৈনন্দিন জীবনে আলসেমি ও স্থবিরতা খুব সাধারণ একটি বিষয়, যা আমাদের অনিদ্রা এবং ফ্যাটিগ উভয়ের জন্যই দায়ী। সেক্ষেত্রে কোন জিম ট্রেইনার কিংবা ফিটনেস এক্সপার্টের সাথে পরামর্শ করে নিজের শারীরিক কর্মক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট এক্সারসাইজের অভ্যাস করা উচিত।
শারীরিক অনুশীলন ছাড়াও যোগব্যায়াম এর মত শান্ত ও শিথিল চর্চাও একজন ফ্যাটিগ রোগীর মানসিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে বেশ সহায়ক।
কয়েকজন ফ্যাটিগ আক্রান্ত ব্যক্তির ওপর চার সপ্তাহের একটি যোগব্যায়ামনির্ভর গবেষণা চালিয়ে বিশেষজ্ঞরা পর্যবেক্ষণ করেন যে, তারা সকলেই ধীরে ধীরে ফ্যাটিগ, দুঃশ্চিন্তা এবং ডিপ্রেশন থেকে ধীরে ধীরে মুক্তি পাচ্ছেন।
উল্লেখ্য, চার সপ্তাহের এই প্রোগ্রামটিতে মেডিটেশন, শ্বাস-প্রশ্বাস, ভঙ্গিমা ছাড়াও আরো অন্যান্য যোগব্যায়ামের অনুশীলন অন্তর্ভুক্ত ছিলো। (তথ্যসূত্র: মেডিক্যাল নিউজ টুডে)
শারীরিক অবসাদ দূর করার উপায় নিয়ে শেষ কথা
ফ্যাটিগ এমন একটি বিষয়, যা আমাদের দৈনন্দিন কাজ ও অভ্যাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা অনেকেই এটিকে নিতান্তই মামুলি বিষয় কিংবা বয়সের দোষ বলে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করি কিন্তু, আদতে এটি মোটেও হেলাফেলার বিষয় নয়।
শারীরিক অবসাদ দূর করার উপায় হলো নিজের স্বাস্থ্য এবং লাইফস্টাইল সম্পর্কে সুনিশ্চিত থাকা, এবং সুস্থ জীবনযাপনে নিজেদের অভ্যস্ত করা।